ভাঙারি দোকানে বিনা মূল্যের বই

উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার নাটকের একটি দৃশ্যে দেখা যায়, ‘দ্য গ্রেট বেঙ্গল অপেরা’র মহড়াকক্ষে হাজির হন প্রিয়নাথ মল্লিক নামের এক তরুণ নাট্যকার। তিনি ওই অপেরার পরিচালক বেণীমাধব চাটুজ্যে ওরফে কাপ্তেন বাবুকে মাসখানেক আগে তাঁর নিজের লেখা নাটক পলাশীর যুদ্ধ পড়তে দিয়েছিলেন। নাটকটি কাপ্তেন বাবুর কেমন লেগেছে এবং সেটি মঞ্চস্থযোগ্য কি না, সেই খোঁজ নিতেই তিনি এসেছেন। অতিথি প্রিয়নাথকে মুড়ি খেতে দেওয়া হয় কাগজের ঠোঙায়। মুড়ি খেতে খেতে কাপ্তেন বাবুর সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধ নাটক নিয়ে আলোচনা করছিলেন প্রিয়নাথ। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হলো, তাঁর হাতে যে ঠোঙাটা ধরা, সেটি পলাশীর যুদ্ধ—পৃষ্ঠা নম্বর ৩২১। কাপ্তেন বাবুর হাতের ঠোঙা বানানো হয়েছে পলাশীর যুদ্ধ—পৃষ্ঠা নম্বর ৩০৭ দিয়ে।

প্রতিবছর এই সময়ে দেশের আনাচকানাচে মহাসমারোহে টিনের তলোয়ার নাটকের এই দৃশ্য মঞ্চায়িত হয়। সরকার বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য যে পাঠ্যবই ছাপায়, তার একটা অংশ পাওয়া যায় ভাঙারির দোকানে। যাঁরা বই বিতরণের দায়িত্বে থাকেন, তাঁরা কেজি দরে বইগুলো ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছে বেচে দেন। প্রিয়নাথের পলাশীর যুদ্ধ নাটক দিয়ে মুড়ির ঠোঙা বানানোর মতো তাঁরা এই পাঠ্যবই দিয়ে ঠোঙা বানান। দু-একটা ঘটনা ধরা পড়ে। সেগুলো খবরে আসে। বাকিগুলো বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে যায়।

গত বছরের মে মাসে বাগেরহাট শহরের একটি ভাঙারির দোকান থেকে ১৬ বস্তা বই উদ্ধার করা হয়েছিল। একই সময়ে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার শহরতলি কালিকাপুর এলাকার একটি মুদিদোকান থেকে দেড় হাজার বই জব্দ করা হয়েছিল। ওই সময় নানা জায়গায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। কাউকে কাউকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারি বই দিয়ে ঠোঙা বানানো বন্ধ করা যায়নি। এ বছরও একই ঘটনা ঘটেছে। গত বুধবার হবিগঞ্জ শহরের একটি ভাঙারির দোকান থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় পাঁচ হাজার নতুন বই উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে ৯ জানুয়ারি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে বিনা মূল্যের বই কেজি দরে ভাঙারি দোকানে বিক্রি করার পর আটক হন কাঁঠালতলা গিয়াসিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আবদুল হালিম। ধরা পড়া এবং মামলার সুবাদে ঘটনাগুলো সংবাদমাধ্যমে আসছে। ধারণা করা অযৌক্তিক নয়, এ রকম আরও ঘটনা দেশজুড়ে ঘটছে, যেগুলো ধরা পড়ছে না।

ঠোঙাশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে যেসব ‘কুটিরশিল্প সংবেদনশীল’ মানুষ শিশুদের বঞ্চিত করে পাঠ্যপুস্তক ভাঙারির দোকানে বেচে দিচ্ছেন, তঁারা হয় শিক্ষক, নয়তো শিক্ষাদানের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট। তাঁদের কড়া সাজার আওতায় আনা উচিত। প্রশাসন তথা সরকারের মধ্যে এই উপলব্ধি দ্রুত জাগ্রত হওয়া দরকার।