কয়েক শ নৌযান আটকা

পানির ধর্ম নিচের দিকে যাওয়া। সাগরের পানি বাষ্প হয়ে মেঘ হয়। মেঘ স্থলভাগে বৃষ্টি হয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানি নানা পথ তৈরি করে গড়িয়ে যায় সবচেয়ে নিচু জায়গায়; মানে সাগরের দিকে। পানিপ্রবাহের এই নির্দিষ্ট পথগুলোই নদী।

ফাইভ–সিক্সের বইয়ে এসব কথা লেখা থাকে। তবু আবার বলা কেন? বলতে হলো এই কারণে যে সহজ পড়া ভুলে গেলে কী দশা হয়, তা প্রকৃতিরূপী শিক্ষক প্রতিনিয়ত কান ধরে দেখিয়ে দিচ্ছে। সমস্যা হলো, কান ধরায় কাজ হচ্ছে না। কখনো কখনো প্রকৃতি কান ছেড়ে দিয়ে ‘বেতমারা’ শুরু করে। তখন খানিক সময়ের জন্য সবার হুঁশ আসে। তখন ‘নদী বাঁচাও’ জাতীয় নানা প্রকল্প, সভা, সেমিনার হয়।

আগে জলস্ফীত নদীর বন্যা যেমন স্বাভাবিক ছিল, তেমনই কয়েক দিনের মধ্যে সেই পানি নেমে যাওয়াও স্বাভাবিক ছিল। বাড়তি পানি ওপরের দিক থেকে নদী দিয়ে গড়িয়ে যেত নিম্নভূমির দিকে। এই যাওয়ার পথে স্রোতোধারা নিজের পথটিকে আরও গভীর করে কেটে নিত। পানির কোদালে নদীতে জমা মাটির কিছু তুলে ফেলে দিত দুই পাড়ে। বাকিটুকু চলে যেত মোহনার দ্বীপে।

দেশের কয়েক লাখ দিঘি-পুকুর, হাওর ছিল অতিবর্ষণের জল সঞ্চয়ে রাখার স্থায়ী আধার। এমনকি মাটির তলার ‘পাতালঘরে’ও পানি জমা করত তারা। এই পানি ছোট ছোট নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করত ভূমিজলের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে না দিয়ে। গেরস্ত যেমন সমৃদ্ধির সময়ে টাকা পয়সা সঞ্চয় করে রাখে ভবিষ্যৎ অসময়ের জন্য, অধিক বৃষ্টির পানিকেও দেখা হতো সে ভাবেই। কিন্তু কোটি কোটি ঘনফুট পানি ধরে রাখার সেই পাত্রগুলোকে (দিঘি, পুকুর, খাল, ইত্যাদি) মূলত নগদ অর্থকরী বিষয়ে রূপ দিতে ভরাট করার প্রতিযোগিতা চলছে। এতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা, যা মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সুস্থায়ী শর্ত।

একদিকে পানির প্রস্থানপথ বন্ধ করা হচ্ছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে গভীর নলকূপ বসিয়ে পাতালের পানি টেনে তোলার অবিমৃশ্যকারিতা।

খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে, সীমান্ত এলাকা থেকে বালু, পাথর এবং ভারত থেকে আমদানি করা কয়লা সুনামগঞ্জের বৌলাই নদ দিয়ে নৌকাযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। কিন্তু বৌলাই নদের নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের পাশে নদে পণ্যবোঝাই চার শতাধিক নৌযান আটকা পড়েছে। এক সপ্তাহ ধরে আটকে থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন নৌযানমালিক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। প্রায় প্রতিবছরই সেখানে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষায় উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পলিতে নদের বিভিন্ন স্থান ভরাট হয়ে গেছে। এখন নদ খনন না হলে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। দেশের অধিকাংশ নদ–নদীর অবস্থা বৌলাই নদের মতো। এসব নদ–নদীর নাব্যতা এখনই ফেরানো না গেলে প্রকৃতি ‘বেত মারতে’ দুবার ভাববে না।