অনুপস্থিত চিকিৎসক

রাজধানীসহ দেশের আটটি জেলার ১১টি সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযান চালিয়ে যেসব তথ্য পেয়েছে, সেটি উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হয়। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ঢাকাসহ ৮ জেলার ১১টি সরকারি হাসপাতালে অভিযান পরিচালনার সময় চিকিৎসকদের কাজের সময়ের রোস্টার পর্যালোচনা করে দেখা হয়, ২৩০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৯২ জনই অনুপস্থিত, যা মোট চিকিৎসকের ৪০ শতাংশ। ঢাকার বাইরের ৭ জেলার হাসপাতালগুলোতে ১৩১ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৮১ জনই অনুপস্থিত ছিলেন, যা মোট চিকিৎসকের প্রায় ৬২ শতাংশ।

আগে দেখা যেত গ্রামাঞ্চলেই চিকিৎসকেরা কর্মস্থলে গরহাজির থাকেন। এখন দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর হাসপাতালেও অনেকে অনুপস্থিত থাকেন। এটি যদি তাঁদের বদভ্যাস হয়ে থাকে, তাহলে সেটি দুদকের অভিযান কিংবা হাজিরা খাতা পরীক্ষা করার মতো টোটকা ওষুধে দূর করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন সমস্যার কারণ খুঁজে বের করে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া।

দুদক সূত্র জানায়, সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকের অনুপস্থিতির কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা হয়রানির শিকার ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, দুদকের অভিযোগ কেন্দ্রে (১০৬) আসা এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে যেসব হাসপাতালে দুদক অভিযান চালায়নি কিংবা চিকিৎসাপ্রার্থীরা দুদকের কাছে অভিযোগ করেননি, সেসব হাসপাতালের অবস্থা এর চেয়ে ভালো তা বলা যাবে না।

চিকিৎসকদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতি নিয়ে এর আগে প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। চিকিৎসকদের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার প্রথম দায় চিকিৎসকের, যিনি রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার পেশাগত ওয়াদা করেও তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে চলেছেন। দ্বিতীয় দায় সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। তারা স্বাস্থ্য প্রশাসনকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনতে পারেনি। ঊর্ধ্বতনরা যদি নিয়মনীতি মেনে চলেন, অধস্তনদের সেটি মানতে বাধ্য করতে পারেন। আর সেখানে ঘাপলা থাকলে তার জের গিয়ে পড়বে তৃণমূল পর্যন্ত।

অভিযোগ আছে, তদবির ও প্রভাব–প্রতিপত্তি খাটিয়ে অনেক চিকিৎসক বড় শহর বা এর উপকণ্ঠে পদায়ন পেয়ে থাকেন। অন্যরা বঞ্চিত হন, যদিও দক্ষতা ও যোগ্যতায় তাঁরা এগিয়ে আছেন। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য প্রশাসন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের প্রতি যে অবিচার করেছে, তার জন্য কঠোর শাস্তি পেতে হচ্ছে চিকিৎসাপ্রার্থী সাধারণ মানুষকেই। এটি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।

অতএব, চিকিৎসকদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকা নিশ্চিত করতে হলে তাঁদের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কঠোরভাবে আইন ও বিধিমালা মেনে চলতে হবে; কোনো ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। সেই সঙ্গে চিকিৎসকেরা যেখানে পদায়িত হবেন, সেখানে তাঁদের নিরাপত্তা এবং কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও চিকিৎসক ও নার্সদের আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসক ও কর্মচারীদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হলে আবাসনের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আবাসন যদি তাঁদের সেখানে কাজের পূর্বশর্ত হয়, চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে নয় কেন?

স্বাস্থ্য প্রশাসনে কর্মস্থলে চিকিৎসক না থাকাই একমাত্র সমস্যা নয়। অনেক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। অবকাঠামো থাকলেও ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব আছে। ঘাটতি আছে নার্স ও কর্মচারীরও। সেসব পূরণ করতে না পারলে জনসাধারণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা অলীক কল্পনাই বটে।