কেন ডাকসু নির্বাচন

প্রায় ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১১ মার্চ। আগের যেকোনো নির্বাচনের তুলনায় এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে। আগের পরিস্থিতি কী ছিল, তা কিছুটা বললে এটা বোঝা যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। ক্যাম্পাস থেকে তত দিনে তৎকালীন সরকারি দলের (জাতীয় পার্টি) ছাত্রসংগঠন বিতাড়িত হয়েছে। সে সময় ক্যাম্পাস এলাকা, ছাত্রাবাস, মধুর ক্যানটিন, মল চত্বর, কখনো কখনো কলাভবনের করিডর মুখরিত থাকত অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর বিচরণে। ছাত্রদল, ছাত্রলীগ তো বটেই, বাম ছাত্রসংগঠনগুলোও সার্বক্ষণিকভাবে ক্রিয়াশীল ছিল ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলোও মুখরিত থাকত এদের প্রাণচাঞ্চল্যে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর জন্য নির্বাচনটি ছিল নতুন স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার বিষয়। এই নির্বাচনে গঠিত ডাকসুর মাধ্যমে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করার স্বপ্ন ছিল। বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর আকাঙ্ক্ষা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষা অধিকারসংক্রান্ত দাবিদাওয়া আদায় করারও।

ডাকসুর ও হল সংসদের সেই নির্বাচনে ছাত্রদল অধিকাংশ বিজয়ী হয়েছিল, কিন্তু এ নিয়ে কোনো বিতর্ক ওঠেনি। বিতর্ক ওঠেনি ঠিক আগেকার ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও অন্যান্য বাম সংগঠনের যৌথ প্যানেলে বিজয় নিয়েও। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বিরাট ভূমিকা রেখেছিল এ দুটো ডাকসু। এরপর অনেক বছর ধরে বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রেখেছিল এসব নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বেগবান হয়ে ওঠা প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর কর্মচাঞ্চল্য।

এরপর ১৯৯০ সাল–পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলগুলোয় আর ডাকসু নির্বাচন হয়নি বিভিন্ন কারণে। ডাকসুর মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনের শক্তিশালী একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। ডাকসুতে সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠন জয়ী হতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে সরকারগুলো তাই এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনীহ ছিল। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ও সুযোগ না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর বড় নেতাদেরও অনাগ্রহ ছিল। ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অর্থবহ কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার–ঘনিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোয় ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য। ১০ বছর যাবৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তাদের ছাত্রসংগঠনটির আধিপত্য আরও প্রকট হয়ে উঠেছে দিনে দিনে।

এই আধিপত্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অন্য সংগঠনের রাজনীতি করা দূরের কথা, ছাত্রলীগ না চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও অবস্থান করারই সাহস বা ক্ষমতা নেই কারও। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও কমবেশি একই অবস্থা বিরাজমান। অন্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্র হত্যা, ছাত্রের অপমৃত্যু, বিভিন্ন সংগঠন, এমনকি অরাজনৈতিক সংগঠনের ওপর হামলার বহু অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অর্থবহ পদক্ষেপ নেওয়ার সদিচ্ছা দেখায়নি সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা অন্য কেউ। হল, ক্যাম্পাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অঞ্চলে এখন ছাত্রলীগের রয়েছে নজিরবিহীন একক আধিপত্য।

২.
এমন একটি পরিস্থিতিতে ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ কেন নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? আমরা আদালতের নির্দেশনার কথা শুনেছি। কিন্তু সরকার চাইলে আদালতের নির্দেশনা বহুকাল ধরে ঝুলিয়ে রাখা যায়—এমন উদাহরণ আমরা দেখেছি খুন, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বড় দুর্নীতির মামলাগুলোতেও। কাজেই শুধু আদালত বলেছেন বলে নয়, এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের নিজের আগ্রহও রয়েছে, তা ধারণা করা যায়। তা না হলে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়ার কথা নয়।

প্রশ্ন হচ্ছে কেন সরকার তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত একটি পরিবেশে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঝুঁকি নিচ্ছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ঐতিহ্যগতভাবে অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট চেতনার অধিকারী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সন্ত্রাস, অনিয়ম ও খবরদারির যেসব অভিযোগ রয়েছে, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে তারা যে ভূমিকা রেখেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হলে তাদের পরাজিত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি হওয়ার কথা।

তাহলে জেনেশুনে সরকার কি এই ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে? নাকি একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজের ছাত্রসংগঠনকে বিজয়ী করার আত্মবিশ্বাস রয়েছে বলেই সরকার এই নির্বাচনের সবুজ সংকেত দিচ্ছে? এসব প্রশ্নের সুরাহা না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার, এমনকি তা আদৌ অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে। অনিশ্চিত থাকবে এতে অন্যান্য সংগঠন ও ছাত্রদের একটি বড় অংশের অংশগ্রহণও।

৩.
এসব অনিশ্চয়তা দূর করার মূল দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগ্রহ থাকলে শুধু হবে না, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে এটি সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন ও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা করেছে। কিন্তু এসব আলোচনায় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যেসব প্রস্তাব এসেছে, তা গ্রহণ করার সদিচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে এখনো দেখা যাচ্ছে না। যেমন হলগুলোয় ছাত্রলীগের একচ্ছত্র অবস্থান এবং দাপটের কারণে ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগ বাদে বাকি সব সংগঠন একাডেমিক ভবনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের যুক্তি, হলে সহাবস্থানের কোনো পরিবেশ নেই, এখানে নির্ভাবনায় ভোট দেওয়ার সাহস পাবেন না আবাসিক ছাত্রছাত্রীরা, ভোট দিতে আগ্রহী হবেন না অনাবাসিক ছাত্রছাত্রীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই দাবির বিপরীতে বলছেন যে হলে নাকি সহাবস্থানের পরিবেশ রয়েছে। অথচ গত কয়েক বছরে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হল থেকে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের বের করে দেওয়া, হলের আসন বণ্টন নিজেদের কর্তৃত্বে রাখা এবং হলের ছাত্রদের জোর করে নিজেদের কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করার বহু সংবাদ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের জন্য ক্যাম্পাস কতটা অনিরাপদ, তার সাম্প্রতিকতম প্রমাণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে দুই দফা আলোচনার জন্য ছাত্রদলের নেতাদের প্রক্টরিয়াল বডির মাধ্যমে বিশেষ নিরাপত্তা দিতে হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা বারবার ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন, এমনকি ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তাঁদের নেতাদের হেনস্তা করার অভিযোগও রয়েছে। সব দেখেশুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ রয়েছে—এটি বলেন কীভাবে?

নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত না করা হলে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সুযোগ পাবে না। একাডেমিক ভবনগুলো (যেমন ফ্যাকাল্টিভিত্তিক) ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা না করলে, ভোটকেন্দ্রে সব ধরনের মতামতের শিক্ষকদের দায়িত্ব না দিলে এবং ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা (যেমন মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করে) নিশ্চিত না করা হলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভোটদানে ভীতি ও অনীহা দূর হবে না। এসব লক্ষ্যে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে শিক্ষকদের নিয়ে যে তিনটি কমিটি গঠন করেছে, দু–একজন বাদে তার সব সদস্য সরকারি দলের সমর্থক প্যানেলে নির্বাচন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে ছাত্রলীগ বাদে অন্য কারও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

ডাকসুর নির্বাচন তাই কেমন হবে বা আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না অনেকের। অল্প কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ডাকসু নির্বাচন এভাবে অনুষ্ঠানের কোনো চিন্তা কারও মধ্যে থাকলে তা ডাকসুর প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্রকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে।

আমরা আশা করব, এমন চিন্তা কারও মধ্যে থাকলে, তা অচিরেই দূর হবে। আশা করব, ১১ মার্চে সত্যি সত্যি ছাত্রদের পছন্দের নেতৃত্ব ডাকসুতে অধিষ্ঠিত হবে।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক

আরও পড়ুন: