বাংলা পাঠ্যবইয়ে নারী ও পুরুষ 'দর্শন'

প্রাথমিকের বিভিন্ন শ্রেণির বাংলা বইগুলোর প্রচ্ছদ।
প্রাথমিকের বিভিন্ন শ্রেণির বাংলা বইগুলোর প্রচ্ছদ।

বেশ কয়েক দিন আগে ‘ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে নারী ও পুরুষ’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে আমি বিশ্লেষণ করেছিলাম জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি, অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের ইংরেজি বইগুলোয় নারী ও পুরুষের তুলনামূলক অবস্থান। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলেন, লেখাটি ছিল জোর করে নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতা দৃশ্যমান করার একটি প্রয়াস। তাঁদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, এই বৈষম্যগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অভ্যস্ত চোখে ধরা পড়ে না এবং সেভাবেই চলতে থাকে। বিষয়টি সামনে নিয়ে এলে অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয় বাড়াবাড়ি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বিষয়গুলো লক্ষ করি না কিংবা লক্ষ করেও এড়িয়ে যাই। কিন্তু এর প্রভাব রয়ে যায় শিশুমনে। কারণ, শিশুদের চেয়ে বড় পর্যবেক্ষক আর কেউ না। আমাদের সমাজ তো বটেই, এমনকি আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোর উদাসীনতা ওদের কোমল অন্তরকে ভাবতে শেখায়, নারী আর পুরুষ সমান নয়; এক নয় তাদের সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা।

এবার হাতে তুলে নিলাম জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা বইগুলো; যার নাম ‘আমার বাংলা বই’। এই পাঁচখানা বই পড়া শেষ করে মনে হলো, বইগুলো সত্যিই শিশুদের জন্য ‘বাংলা বই’ হয়ে উঠতে পেরেছে কি? প্রাথমিক স্তরের প্রায় অর্ধেক মেয়ে শিক্ষার্থী হলেও বই রচনা কমিটিতে, বইয়ের অলংকরণে, কবি-সাহিত্যিক নির্বাচনে এবং বিষয়বস্তু নির্বাচন ও তার বিন্যাসে প্রকটভাবে ধরা পড়েছে নারী ও পুরুষের অসমতার বিষয়টি।

প্রথম শ্রেণির বাংলা বইটি মনে বেশ আশার সঞ্চার করেছিল। বইয়ের প্রচ্ছদ, ভেতরের অলংকরণ, ছড়ায় এবং বর্ণনায় ছেলে ও মেয়েশিশুর অংশগ্রহণ ও উপস্থাপন ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু যতই ওপরের শ্রেণিতে ওঠা গেছে, ততই বইগুলোয় পুরুষের চিত্রায়ণ এবং তাদের একচেটিয়া অংশগ্রহণ প্রকট হয়ে উঠেছে। কর্মজীবী নারীর ভূমিকায় একমাত্র শিক্ষকতাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুরা পেয়েছে সোমা আপা, রূপা আপা, সাহানা আপা ও মাকসুদা আপার কথা। নারী ও পুরুষ শিক্ষকদের ভূমিকাতেও বেশ তারতম্য পরিলক্ষিত হয়েছে। নারী শিক্ষকেরা যেখানে স্কুলসংলগ্ন এলাকায় গাছ লাগানো, স্বাধীনতা দিবস কিংবা বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনে ব্যস্ত, সেখানে চতুর্থ শ্রেণিতে হাসান স্যারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিশুদের নিয়ে সোনারগাঁ ঘুরে আসার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। তৃতীয় শ্রেণিতে ছবি আর ইজাজকে ঢাকার রাস্তা আর ট্রাফিক সিগন্যালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন একজন পুরুষ। প্রায় প্রতিটি বইয়েই ঘোমটা মাথায় বাংলা মায়ের ‘শাশ্বত’ রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। মায়ের সন্তানবাৎসল্য ও সেবার দিকটি বারবার প্রতিফলিত হলেও মায়ের আত্মপ্রত্যয়ী এবং তেজস্বী সত্তা ধরা পড়েনি কোথাও। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের অধিকাংশ চরিত্র আঁকার সময় শিল্পীর কল্পনায় পুরুষের উপস্থিতিই পরিলক্ষিত হয়েছে।

এটা কি বাস্তবসংগত? দেশের শাসনকাজের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় একজন নারী। বিরোধী দলেও তাই। সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছে, চিকিৎসা পেশায় পুরুষের চেয়ে নারী বেশি। সেনাবাহিনী ছাড়া যথেষ্ট সংখ্যায় নারী নেই—এমন কোনো ক্ষেত্র পাওয়া কঠিন। পাঠ্যপুস্তক যেখানে শত শত বছর ধরে চলে আসা বৈষম্য থেকে বেরোতে বাস্তবতা থেকে একটু এগোনো আগামীর ছবি দেখাবে, সেখানে তাতে দেখানো হয়েছে ছেড়ে আসা অতীতের বাস্তবতা। এটা কি বাস্তব–উপযোগী হলো?

প্রাথমিক শিক্ষার বাংলা বইয়ের সম্পূর্ণ যাত্রায় শিশুরা দেখা পেয়েছে হাতে গোনা মাত্র তিন–চারজন নারী কবি-সাহিত্যিককে, যা মোট কবি-সাহিত্যিকের ১০ শতাংশেরও কম। ভাগ্যবান নারী কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে রয়েছেন কবি সুফিয়া কামাল, কুসুমকুমারী দাশ ও সেলিনা হোসেন। পাঠ্যবইয়ের জন্য কবি-লেখক নির্বাচনে পুরুষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব সাহিত্যে নারীর অবদান সম্পর্কে শিশুমনে ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিতে পারে। অন্যদিকে, বইগুলোয় আলোকিত মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শিল্পী কামরুল হাসান, খলিফা হজরত আবু বকর (রা.), হজরত উমর (রা.), জগদীশচন্দ্র বসু, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ অনেকে স্থান পেলেও মহীয়সী নারী হিসেবে স্থান পেয়েছেন একমাত্র বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখাগুলোয় নারীর ত্যাগ কিংবা অংশগ্রহণ শুধু বইয়ের ছবিতে মিছিলে অংশগ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের ছবি কিংবা কবি-সাংবাদিক মেহেরুন্নেসার নাম উল্লেখ করা হলেও অন্য পুরুষ বুদ্ধিজীবীদের মতো তাঁরা উজ্জ্বল হয়ে ওঠেননি। একমাত্র পঞ্চম শ্রেণিতে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা সেলিনা হোসেনের ‘অপেক্ষা’ গল্পে রুমা কিংবা রুবাকে শিশুরা খুঁজে পেলেও তাদের কাছে স্পষ্ট হয়নি মুক্তিযুদ্ধে এই দুই বোনের ভূমিকা। পঞ্চম শ্রেণিতে ‘কাঞ্চনমালা আর কাঁকনমালা’ গল্পে দুটি নারী চরিত্রকে খুঁজে পায় শিক্ষার্থীরা । কাঞ্চনমালা স্বামী–অন্তঃপ্রাণ এবং স্বামীর সেবায় নিয়োজিত। অন্যদিকে, কাঁকনমালা কুচক্রী ও লোভী। অবশেষে গুণবতী কাঞ্চনমালা কুচক্রী কাঁকনমালার সব চক্রান্তকে পরাজিত করে স্বামীর প্রতি অনুগত ও সৎ থাকার পুরস্কার লাভ করেন। হাজারো বাস্তব পুরুষ চরিত্রের ভিড়ে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত এই দুই নারী চরিত্রকে শিশুদের আমোদ হিসেবে গ্রহণ করারই সম্ভাবনাই বেশি। তৃতীয় শ্রেণিতে ‘রাজা ও তাঁর তিন কন্যা’ গল্পে ‘সুন্দরী কন্যা’ শব্দ দুটির ব্যবহার রীতিমতো অস্বস্তিকর ঠেকেছে।

সামনের দিনগুলোয় পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নির্বাচনে আরও জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে কখনোই শিশুদের ‘আমার বাংলা বই’ সবার বাংলা বই হয়ে উঠবে না। শুনেছি, অচিরেই প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলাম রিভিউ করা হবে। তাই এই বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়া এখন সময়ের দাবি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর উন্নয়ন ও অংশগ্রহণ যদি পাঠ্যপুস্তকে প্রতিফলিত না হয়, তবে তা শিশুমনে সন্দেহের উদ্রেক করবে। শিশুরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়োজনে পাঠ্যবই পড়লেও মনে তার ছাপ রয়ে যায়। ভবিষ্যতে এমন নাগরিক কি আমরা চাই, পাঠদানের প্রক্রিয়ায় যারা কমবেশি নারী-বৈষম্যকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেবে? আবার বাস্তবে যে শিশুরা ঘরে বা বাইরে মা-বোন-খালা কিংবা অন্য কোনো নারীর স্বনির্ভর কর্মকাণ্ড দেখে, পাঠ্যপুস্তকে তার প্রতিফলন না পেয়ে হয়তো তারা ভাববে, পাঠ্যপুস্তকে সত্য লেখা থাকে না। ফলে, ব্যাহত হবে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]