যুবলীগ নেতাকে 'তুলে নেওয়া'

গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নাটোর শহরে চার-পাঁচজন লোক নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে জামিল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে তাঁর বাড়ির পাশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ‘তুলে নিয়ে গেছে’। জামিল হোসেনের পরিবারের সদস্যদের এ অভিযোগ বাংলাদেশে ব্যতিক্রমী কিছু নয়, এমন খবর প্রায়ই প্রকাশিত হয়। এই খবরটি সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। কারণ, জামিল হোসেন সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন, সরকারের বিরোধী পক্ষেরও কেউ নন। তিনি সরকারপন্থী যুবলীগের নাটোর জেলা শাখার প্রস্তাবিত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নাটোর সদর উপজেলা থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের একজন।

তা ছাড়া, জামিল হোসেনের আরও একধরনের পরিচিতি আছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে বলা হয়েছে: তাঁর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, জমি-জলাশয় জবরদখল করা, সরকারি কর্মকর্তাকে প্রহার করা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ১৩টি মামলা আছে। ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাঁদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে শিথিলতা দেখায়, কখনো কখনো নিষ্ক্রিয় থেকে যায়। এদিক থেকেও নাটোরের জামিল হোসেনকে ‘তুলে নেওয়ার’র ঘটনা ব্যতিক্রমী বটে।

এ ঘটনা সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে আরও একটা কারণে। সেটা হলো জামিল হোসেনকে ‘তুলে নেওয়া’র প্রতিবাদে এবং তাঁকে উদ্ধার করার দাবিতে পরদিন শুক্রবার নাটোর শহরে তাঁর সমর্থকদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, অবরোধ। তাঁরা দুই দফায় কয়েক ঘণ্টা ধরে মহাসড়ক অবরোধ করে যানবাহন চলাচলে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন। এটাও একটা নিন্দনীয় প্রবণতা যে ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতা-কর্মী গুরুতর কোনো অপরাধ করে গ্রেপ্তার হলে তাঁর সমর্থকেরা প্রতিবাদ-বিক্ষোভে জনজীবনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন এবং আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়াকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টি করতে চান। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

কিন্তু জামিল হোসেনের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, ঠিক কারা তাঁকে ‘তুলে নিয়ে’ গেছে, তা পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। তাঁর পরিবারের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে র‍্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে তারা কিছু জানে না। এ পরিস্থিতিতে আমাদের প্রথম বক্তব্য হলো, লোকজনকে ‘তুলে নেওয়া’র অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে কখনোই স্বীকার করা হয় না বটে, কিন্তু ইতিমধ্যে এটা একটা সাধারণ ধারণায় পরিণত হয়েছে যে তারা কখনো কখনো এই কাজটি করে। দ্বিতীয়ত, তারা নিজেরা যদি জামিল হোসেনকে তুলে নিয়ে না থাকে, তাহলে তারা এ সম্পর্কে কিছু জানে না বলে দিলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয় না। তাঁকে খুঁজে বের করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া এবং যারা তাঁকে ‘তুলে নিয়ে’ গেছে, তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে জনসাধারণকে প্রকৃত ঘটনা জানানোও তাদেরই দায়িত্ব।

কিন্তু যদি জামিল হোসেনের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগই সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমরা বলব, অপরাধ দমন ও অপরাধের বিচার করার যথাযথ আইনানুগ পন্থা অবলম্বনের কোনো বিকল্পই গ্রহণযোগ্য নয়। জামিল হোসেন ১৩টি ফৌজদারি মামলার আসামি—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ বক্তব্য সত্য হলে সেই আসামিকে যথাযথ আইনানুগ পন্থায় গ্রেপ্তার করায় বাধা কোথায়? কেন রাতের অন্ধকারে বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় তাঁকে ‘তুলে নিয়ে’ যেতে হবে? আইনের শাসনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই বেআইনি চর্চা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। আইন প্রয়োগকারীদের হাতে আইন আছে, তারা তার যথাযথ প্রয়োগের সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনায় সচেষ্ট হোক। এ ধরনের বেআইনি চর্চা বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য উৎসাহিত করে। জামিল হোসেনের সমর্থকদের কর্মকাণ্ড তারই প্রমাণ।