অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ কি খেলাপি নয়?

গত ২৮ জানুয়ারি প্রথম আলোতে অবলোপনকৃত মন্দ ঋণের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই কলামে সংবাদটির গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করছি, কারণ অনেকেই মন্দ ঋণ অবলোপনের প্রকৃত মাজেজাটি বুঝতে পারেন না। সংবাদে জানা যাচ্ছে, ২০০২ সালে পাঁচ বছরের বেশি সময়ের অনাদায়ি মন্দ ঋণের ‘রাইট অফ’ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ৪৯ হাজার 

৭৪৫ কোটি টাকা রাইট অফ করেছে। সংবাদে বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই রাইট অফ করা মন্দ ঋণের ১১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। খবরে এরপর বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আদায় হওয়া মন্দ ঋণের ব্যাংকওয়ারি পরিমাণ দেখানো হয়েছে।

জনগণ যাতে বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত নয় হয়, সে জন্যই আজকের লেখা। যে ১১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা রাইট অফ করা মন্দ ঋণ আদায় হয়েছে বলে জানানো হয়েছে, ওগুলো ‘সুদাসলে আদায়কৃত মন্দ ঋণ’। অতএব, ওই অঙ্কটিকে ৪৯ হাজার ৭৪৫ দিয়ে ভাগ করে যদি কেউ খুশি হয়ে যান যে প্রায় ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ রাইট অফ করা মন্দ ঋণ আদায় করে ব্যাংকগুলো বেশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে, তাহলে তাঁরা মারাত্মক ভুল করবেন। আসলে এই দুটো অঙ্ক মোটেও অনুপাত নির্ধারণের জন্য উপযোগী নয়। ১৬ বছর ধরে মোট ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে আটকে থাকা মন্দ ঋণ হিসেবে ক্রমাগতভাবে রাইট অফ করার পর ওই মন্দ ঋণের ওপর নিয়মিতভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ ধার্য হয়ে চলেছে, কিন্তু যখন রাইট অফ করা মন্দ ঋণের ক্রমবর্ধমান (cumulative) পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশ করা হয় তখন যে সুদ ধার্য হচ্ছে, তার পরিমাণ যোগ করে সুদাসলে ওই মন্দ ঋণের পরিমাণ কত দাঁড়িয়েছে তা বলা হয় না।

অতএব, রাইট অফ করা মন্দ ঋণ ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা সর্বশেষ হিসাব প্রকাশের সময় সুদাসলে কত দাঁড়িয়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংক জনগণকে জানাচ্ছে না। মামলায় জিতে যখন ব্যাংক মন্দ ঋণ আদায় করতে পারে শুধু তখনই ঋণের প্রিন্সিপালের সঙ্গে সুদ যোগ করে সুদাসলে মন্দ ঋণটা আদায় করা হয় (সুদ মওকুফ না হলে)। ব্যাপারটা বুঝতে হলে নিচের ব্যাখ্যাটা প্রয়োজন হবে।

সাধারণত ‘নন-পারফর্মিং’ ঋণের শ্রেণীকরণ তিন ধরনের করা হয়, ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড’ (তিন মাসের বেশি অনাদায়ি), ‘ডাউটফুল’ (ছয় মাসের বেশি অনাদায়ি) এবং ‘ব্যাড ডেট বা লস’ (‌ক্ষেত্র বিশেষে নয় মাস অথবা এক বছরের বেশি সময়ের জন্য অনাদায়ি)। এর মধ্যে ডাউটফুল এবং ব্যাড ডেটগুলোকে খেলাপি ঋণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ব্যাড ডেটকে বাংলায় ‘মন্দ ঋণ’ বলা হয়। ২০০২ সালে চালু হওয়া ‘রাইট অফ সিস্টেমের’ নিয়মানুযায়ী যেসব মন্দ ঋণ পাঁচ বছরেও আদায় করা যায়নি, সেগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে ‘রাইট অফ’ বা অবলোপন করা যায়। রাইট অফ করার মানে হলো এই মন্দ ঋণগুলোকে ব্যাংকের মূল ব্যালান্সশিট থেকে সরিয়ে আলাদা আরেকটি লেজারে হিসাব সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।

রাইট অফ করার মূল দুটো শর্ত হলো: ১. ওই ঋণ সুদাসলে আদায়ের জন্য ব্যাংক মামলা দায়ের করবে, ২. যে পরিমাণ ঋণ ‘রাইট অফ’ করা হয়, তার সমপরিমাণ অর্থ ‘প্রভিশনিং’ বা ‘সঞ্চিতি’ করতেই হবে। প্রভিশনিং মানে হলো ওই পরিমাণ অর্থ ব্যাংক কর্তৃক অন্য কাউকে ঋণ দেওয়া যাবে না। অতএব, প্রভিশনিং করলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সামর্থ্য ওই পরিমাণ সংকুচিত হয়ে যাবে। বিভিন্ন ব্যাংক মামলায় চূড়ান্তভাবে রায় পেয়ে গত ১৬ বছরে যে পরিমাণ রাইট অফ করা মন্দ ঋণ সুদাসলে ফেরত পেয়েছে, তারই পরিমাণ হলো ১১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এই অঙ্কের মধ্যে রাইট অফ করা ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার ৫ শতাংশও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ তো অনেক দূরের কথা। সে জন্যই আমরা বলে চলেছি, রাইট অফ করা বা অবলোপনকৃত মন্দ ঋণের ৯৫ শতাংশের বেশি এখনো অনাদায়ি রয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর এই চরম ব্যর্থতা লুকানোর জন্যই কি বাংলাদেশ ব্যাংক ২৮ জানুয়ারির এই সংবাদটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এভাবে প্রকাশ করল?

মামলা করে ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর খেলাপি ঋণ আদায় করতে অসমর্থ হচ্ছে বলেই সমস্যাটা ইতিমধ্যে সংকটে পরিণত হয়ে গেছে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বিদ্যমান বিচার–প্রক্রিয়া বাংলাদেশে এতই অকার্যকর ও দীর্ঘসূত্রতার শিকার রয়ে গেছে যে অনেক রাইট অফ করা মন্দ ঋণ গত ১৬ বছরেও আদায় করা যায়নি। শত শত কোটি টাকা মন্দ ঋণ অনাদায়ি রেখে বেশ কয়েকজন ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’ মারাও গেছেন, অন্যরা হয়তো বিদেশে ভেগে গেছেন। তবে তাঁদের অধিকাংশই উচ্চ আদালতের মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখে বহাল তবিয়তে দেশের ব্যবসা‌ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে দাবড়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের অনেকেই ব্যাংকের মালিক বনে গেছেন, পরিচালক হিসেবে বছরের পর বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে ব্যাংকিং খাতকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

আমার জানামতে, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের পিতা বা পরিবারের সদস্য এই রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এফবিসিসিআইয়ের বেশ কয়েকজন সভাপতিও এই রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ দেশের রাজনীতি ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কালচারকে’ সযতনে লালন করে চলেছে। অতএব, সংশোধনও শুরু করতে হবে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেই। আর এ জন্য জরুরি প্রয়োজন হলো তিন বছরের জন্য একটি খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ জন ঋণখেলাপিকে চূড়ান্ত বিচারে দ্রুত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ব্যবস্থা হয় রদ করতে হবে, নয়তো আপিলের ক্ষেত্রে রায়ে উল্লিখিত ঋণের অর্থের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ব্যাংককে ফেরত দিলে আপিলের সুযোগ দেওয়া যাবে মর্মে শর্ত আরোপ করতে হবে। আরেকটি বিচারিক পরিবর্তন প্রয়োজন হবে, আদালতের চূড়ান্ত রায় পাওয়ার পর ব্যাংকগুলোকে সহজামানত দখলে নেওয়ার জন্য আবারও যে মামলা করার আইন রয়েছে, সেটারও সংস্কারের উদ্দেশ্যে নতুন আইন প্রয়োজন। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়া আমাদের পথ দেখাতে পারে, ওখানে পুনর্বার মামলার প্রয়োজন হয় না। আরেকটি বড় ধরনের পদক্ষেপ আবশ্যক, সেটা হলো অবিলম্বে ‘ডেট রিকভারি এজেন্সি’ বা ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠার আইন পাস করা। এই এজেন্সি বা কোম্পানিগুলোকে পূর্ণ পুলিশ প্রোটেকশন দিয়ে সহজামানত উদ্ধারে নিয়োজিত করতে হবে এবং সফল উদ্ধারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০ শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা যায়।

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে (বিআইবিএম) আয়োজিত প্রথম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তাঁর বক্তৃতায় তিনি প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপিকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য ঋণখেলাপি ট্রাইব্যুনাল গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ১৯৯৯ সালে আবার একই প্রস্তাব করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান, সরকার সাড়া দেয়নি। বরং একটি সেমিনারে আমার এ-সংক্রান্ত বক্তব্যের জবাবে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া আশ্বস্ত করেছিলেন যে অদূর ভবিষ্যতে দেশে দেউলিয়া আদালত প্রতিষ্ঠা করা হলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এরপর দেউলিয়া আদালত আইন পাস হলো, প্রথম দেউলিয়া ঘোষিত হলেন এরশাদ সরকারের এককালীন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী। তিনি তড়িঘড়ি করে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসার ঘোষণা দেওয়ায় ওই বিষয়ে তাঁর মৃত্যুর আগে আর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। আরও দুর্ভাগ্য, খালেদা জিয়া ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেউলিয়া আদালতে আর কোনো মামলার রায়ও ঘোষিত হয়নি। ১৮ বছর ধরে ওই আদালত ঘুমিয়ে আছে!

ড. মইনুল ইসলাম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক