ফেব্রুয়ারি হোক কবিতার মাস

পৃথিবীর অনেক দেশেই বছরের একটা মাসকে কবিতার জন্য আলাদা করে রাখা হয়। যেমন কানাডা ও আমেরিকায় এপ্রিল হলো কবিতার মাস। আবার যুক্তরাজ্যে অক্টোবর হলো কবিতার মাস। জাতিসংঘ একটি কবিতা দিবসও নির্ধারণ করেছে—২১ মার্চ।

আমাদেরও একটি জাতীয় কবিতার মাস হওয়া উচিত। আমার প্রস্তাব, ফেব্রুয়ারি হোক সেই মাস। আমাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্যে ফেব্রুয়ারির চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মাস আর নেই। আর সে চৈতন্যের কেন্দ্রে বরাবরই কবিতা। কবিতার ভেতরে মানুষের শিকড় গাঁথা, বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে গভীরভাবে সে কথা আর কে জানে। আমাদের দ্রোহের কথা, প্রেমের কথা, বেদনার কথা—সবই আমরা কবিতায় বলেছি। শুধু এখন নয়, বরাবর। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা কবিতাকে হাতিয়ার করেছি। কবিতাকেই অস্ত্র হিসেবে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আমরা যুদ্ধে গেছি।

কবিতা কীভাবে আমাদের শুদ্ধতর মানবে পরিণত করে, তার এক ব্যাখ্যা দিয়েছেন মার্কিন কবি রবার্ট পিনস্কি। তাঁর কথায়, ভাব প্রকাশের জন্য মানুষ যেসব শিল্পমাধ্যম আবিষ্কার করেছে, তার মধ্যে প্রাচীনতম হলো কবিতা। নিজেদের পুরোপুরি জানতে হলে শুধু সমসাময়িক মানুষের সঙ্গে ভাববিনিময় করাই যথেষ্ট নয়, আরও দরকার বিগত ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের সঙ্গে সংযোগ। কবিতা—তা মুদ্রিত, শ্রুত বা ডিজিটাল, যে ফর্মেই প্রকাশিত হোক না কেন, কবিতাই পারে সবচেয়ে ভালোভাবে এই সংযোগ ঘটাতে। কবিতা, যা আমাদের আদিম উৎসের সঙ্গে সম্পর্কিত, তর্কাতীতভাবে মানুষকে তার সেই আদিম কিন্তু চিরনতুন সম্পর্কের সঙ্গে নবায়িত করতে সক্ষম।

আমাদের গভীরতম অনুভূতির কথা কীভাবে কবিতা দিয়ে প্রকাশ সম্ভব, তার এক অসাধারণ উদাহরণ বঙ্গবন্ধু। তিনি কতবার রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে গেছেন, শুধু আবেগ প্রকাশ করতে নয়, যুক্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও। বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সেখানে কয়েক লাখ মানুষের সামনে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বন্ধুদের অবদানের স্বীকৃতি জানাতে কবিতার আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কবিতাটা তাঁর ভালো জানা ছিল, কোনো সমস্যাই হয়নি মনের গভীরে দোল খাওয়া চিন্তা কাব্যের ভাষায় প্রকাশ করতে। এত দিন পরও আমার কানে তাঁর সেই কথাগুলো দোল খায় (রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই)। আমি নিশ্চিত যে লাখ লাখ মানুষ সে ভাষণ শুনেছিল, কারও স্মৃতি থেকেই মুছে যায়নি সেই অভিজ্ঞতা।

ভাষা নিয়ে যত রক্তগরম কথাই আমরা বলি না কেন, নিজেদের মাতৃভাষাটা আমরা খুব ভালো করে রপ্ত করে উঠিনি। রেডিও-টিভিতে প্রতিদিন আমাদের নেতাদের ও বাক্যবাগীশ টক শোর বক্তাদের যেসব কথা শুনি, তাতে মনে হয় না শুদ্ধ ও সুন্দর করে নিজের ভাষা বলার কোনো গুরুত্ব তাঁদের কাছে আছে। নেই, কারণ, কখনো ভালোবেসে নিজের ভাষাকে অধ্যয়নই তাঁরা করেননি। এ অবস্থাটা এখন চাইলেই বদলানো যাবে না, এর জন্য প্রয়োজন প্রস্তুতির, যার শুরু ক্লাসরুমের চার দেয়ালের ভেতর থেকে, একদম প্রথম শ্রেণি থেকে।

কবিতা শেখা মানে ভাষা শেখা। কবিতার পাঠাভ্যাস তৈরি হলে একদিকে ছাত্রদের শব্দভান্ডার যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে তাদের কল্পনাবোধ। শুধু ভাষা ব্যবহার করে কীভাবে আকাশে ওড়া যায়, সেই ম্যাজিকটা তাদের আয়ত্তে আসে। আরও একটা কারণ, সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ এই যে একটি জাতির মেধা ও মনন, তার সংগ্রাম ও স্বপ্নের ইতিহাস খুব সহজেই কবিতার ভেতর দিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচিত করানো সম্ভব। খুব সহজে বলছি বটে, কিন্তু তার জন্য কিছুটা পরিকল্পনা ও উদ্যোগেরও প্রয়োজন আছে। জাতীয় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত না হলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়া অসম্ভব।

কবিতাকে যদি সত্যি সত্যি আমাদের বিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, তাহলে প্রয়োজন পড়বে কিছু পরিকল্পনার, কিছু সুচিন্তিত উদ্যোগের। আমেরিকার একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস ক্লাসরুমের প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য চমৎকার পাঠ কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। এই কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে কবিতার সঙ্গে বিজ্ঞান, কবিতার সঙ্গে ইতিহাস, এমনকি বিশ্বসভ্যতা সংযুক্ত করে আনন্দময় পাঠ্যসূচি। লেখাপড়া যে ভারী কোনো বোঝা নয়, সে কথা প্রমাণে কবিতার চেয়ে যে ভালো কোনো হাতিয়ার নেই, এই পাঠ পরিকল্পনা পড়লেই তা স্পষ্ট হয়। https://www.poets.org/poetsorg/lesson-plans এই ঠিকানায় ইন্টারনেটে তা যে কেউ দেখে নিতে পারেন।

অতীতের অথবা আধুনিক কালের, যেকোনো কবিতায় শুনতে পাওয়া যায় যার যার সময়ের নিজস্ব কণ্ঠস্বর। যেকোনো কবিতা, যেমন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ অথবা শামসুর রাহমানের ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ পড়ার ছলে ছাত্রছাত্রীরা আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। খেলতে খেলতে এই পড়ার কাজটা কার্যকরভাবে কীভাবে করা সম্ভব, একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস তারও চমৎকার পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করেছে। মূল পরিকল্পনাটা গ্রহণ করে, শুধু কবিতাগুলো বদলে নিয়ে, আমাদের দেশেও এই পাঠ পরিকল্পনা প্রয়োগ করা যেতে পারে। https://bit.ly/2FSsvNp এই ওয়েবসাইটে নিজেরাই তা দেখে নিন।

প্রশ্ন হলো, যদি ফেব্রুয়ারিকে কবিতার মাস ঘোষণা করতে হয়, তাহলে কে এই দায়িত্ব নেবে? আমেরিকায় কবিতার মাসের উদ্যোগটি প্রথম গ্রহণ করে একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস ১৯৯৬ সালে। তারপর ক্রমান্বয়ে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশে এই কাজটা বাংলা একাডেমি গ্রহণ করতে পারে। শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাবটি যদি বাস্তবসম্মত মনে হয়, তাহলে শিক্ষা বোর্ডও এ কাজটি করতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেই তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়। যদি এদের কেউ এগিয়ে না আসে, তাহলে যেকোনো শিক্ষক নিজের মতো করে সে কাজে হাত লাগাতে পারেন।

ফেব্রুয়ারিতে এমনিতেই আমরা কবিতায় ডুবে থাকি। পত্রপত্রিকা, রেডিও-টিভি সর্বত্রই কবিতা। কিন্তু ক্লাসরুমে কবিতার আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। যদি সে কাজটা পাঠদানের অংশ হিসেবে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা যায়, তাহলে এখন থেকে ২০ বা ৩০ বছর পর যাঁরা আমাদের দেশের কর্মযোগী হবেন, তাঁরাও বঙ্গবন্ধুর মতো কবিতার ভাষায় কথা বলায় অভ্যস্ত হবেন। শুধু বাংলা ভাষা নয়, জাতির পিতার প্রতিও সেটি হবে এক কাব্যিক নৈবেদ্য।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি