ইসরায়েল ইরানকে যুদ্ধে টানতে চাইছে কেন?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। একাধিক ঘটনা ও পদক্ষেপে তার আভাস মিলেছে। আর এসব ঘটনা-পদক্ষেপ থেকে এটা মনে হচ্ছে যে সংঘাতপূর্ণ ও অশান্ত মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ উসকে দিতে চাইছে ইসরায়েল।

যদিও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক সক্ষমতায় তুরস্ক রয়েছে সবার ওপরে আর তারপর মিসর, তবু তৃতীয় স্থানে থাকা ইসরায়েলের সাফল্যই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত। এরপর যথাক্রমে ইরান ও সৌদি আরবের অবস্থান। এদের চেয়ে সামান্য পিছিয়ে আছে সিরিয়া, ইরাক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু সেনাবাহিনীর আয়তন আর অস্ত্রসম্ভার দিয়ে সামরিক সক্ষমতার এসব তুলনামূলক অবস্থান সব সময় শক্তিমত্তার প্রকৃত চিত্র দেখায় না। বরং সামরিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও নৈপুণ্যে সবার চেয়ে ইসরায়েল এগিয়ে রয়েছে। আর ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের প্রতিটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরবদেশগুলো পরাজিত হয়েছে। তাই ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছে এসব দেশের নেই। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কৌশলগত কারণে সৌদি আরব ও মিসর এখন পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের মিত্র। তুরস্ক সরাসরি শত্রুতা এড়িয়ে চলার পথ নিয়েছে। বাকিরাও কমবেশি নিরাপদ দূরত্বে থাকাকে মঙ্গলজনক মনে করে। গোল বেধেছে সিরিয়া ও ইরান নিয়ে।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে সিরিয়ার গোলান উপত্যকা দখল করার পর ১৯৮২ সালে লেবাননে আগ্রাসন চালানোর সময় তা দামেস্ক পর্যস্ত বিস্তৃত করার পরিকল্পনাও ছিল ইসরায়েলের। আর সিরিয়ার সঙ্গে চিরশত্রুতা আরও চরমে উঠেছে ইরান-সিরিয়া সখ্যয়। লেবাননে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী ও গাজায় হামাস গোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে সহায়তা–সমর্থন দেওয়ায় ইরানের ওপর ক্ষিপ্ত ইসরায়েল। আরবদের সঙ্গে সংঘাতের ইতিহাসে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একমাত্র হিজবুল্লাহ গেরিলাদের কাছেই একপ্রকার নতিস্বীকার করেছে, আর সেটা ২০০৬ সালে। লেবাননের মাটিতে ৩৪ দিনের এই সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে শেষ হয়। ইসরায়েল স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী দিয়ে লেবাননে হিজবুল্লাহর বিভিন্ন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালালে লেবাননের প্রধান বিমানবন্দরসহ অনেক ভৌত অবকাঠামো ও ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়, শ খানেক হিজবুল্লাহ সদস্যসহ প্রায় দেড় হাজার লেবাননি নাগরিক প্রাণ হারায় এবং ১০ লাখ সাময়িকভাবে বাস্তুচ্যুত হয়। বিপরীতে সেনাসহ প্রায় দেড় শ ইসরায়েলি নিহত হয় এবং তিন থেকে পাঁচ লাখ ইসরায়েলি যুদ্ধ চলাকালে হিজবুল্লাহর রকেট হামলা থেকে আত্মরক্ষায় সাময়িকভাবে ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংকারে ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়।

৩৪ দিনের এই যুদ্ধ আসলে ছিল ইসরায়েল-ইরান পরোক্ষ যুদ্ধ। ইরানের কৌশলী সহায়তায় হিজবুল্লাহ বাহিনী অসম শক্তির এই লড়াইয়ে একপর্যায়ে ইসরায়েলকে গেরিলা যুদ্ধে নামতে বাধ্য করে। যুদ্ধ চলাকালে বারবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে রীতিমতো চমক দেখায় হিজবুল্লাহ। এ কারণে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে কাবু করতে ব্যর্থ হয়। বিষয়টি ইসরায়েলের কর্ণধারদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ গড়ার পরিকল্পনাকে অনেকটাই গড়বড় করে দেয়। এই যুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস লেবাননে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণকে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের প্রসববেদনা বলেও অভিহিত করেছিলেন।

এটা ঠিক যে ৩৪ দিনের ওই যুদ্ধের পর গত এক যুগে ইসরায়েল আর হিজবুল্লাহ কোনো সংঘাতে জড়ায়নি। কিন্তু এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে, যা আসলে অঞ্চলটির অস্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো সিরিয়া যুদ্ধ, যা ২০১১ সালে শুরু হয়। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠলে সিরীয় বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত বাধে, যা ব্যাপক গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির কোনো লক্ষণ নেই, তবে বাশার আল–আসাদ টিকে গেছেন। রাশিয়া তার পুরোনো মিত্রকে ত্যাগ করেনি, বরং সব রকম সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্পও সম্ভবত বুঝেছেন যে সিরিয়ায় তাঁদের খেলা আপাতত শেষ। এ কারণে তিনি তাঁর সৈন্য প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছেন ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে, যদিও মাত্র দুই হাজার মার্কিন সেনার উপস্থিতি রয়েছে সিরিয়ায়। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত খোদ তাঁর প্রশাসনেই সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম মেটিস পদত্যাগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও একাধারে ক্ষুব্ধ ও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কেননা, ট্রাম্প কার্যত তাদের এই বার্তা দিচ্ছেন যে তারা যেন নিজেদের মতো করে সিরীয় পরিস্থিতি সামাল দেয়। বিষয়টি ইসরায়েলের জন্য বাড়তি অস্বস্তি ও উদ্বেগ বয়ে এনেছে।

সিরিয়া যুদ্ধে ইসরায়েল প্রথম দিকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়নি, তবে নেপথ্যে আইএসআইএসকে সহযোগিতা করে এসেছে। ইসরায়েলের মূল উদ্বেগ হলো ইরান। বাশারের বাহিনীকে সহযোগিতা করতে হিজবুল্লাহর সদস্যরা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছে। এতে করে হিজবুল্লাহর যুদ্ধ–অভিজ্ঞতা বেড়েছে, অস্ত্রভান্ডারে অস্ত্র জমা পড়েছে। আর এসব অস্ত্রের চালান এসেছে মূলত ইরান থেকে। বাশার বাহিনীর টিকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সিরিয়ার মাটিতে ইরানের ঘাঁটি গাড়ার পরিধি অনেক বেড়ে গেছে। এটা ইসরায়েলকে বড়ভাবে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে, যার বড় প্রমাণ হলো গত কয়েক সপ্তাহে সিরিয়ায় ইরানের বিভিন্ন স্থাপনা ও ঘাঁটিতে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলার ঘটনা। ইসরায়েল সর্বাত্মকভাবে চাইছে লেবাননে হিজবুল্লাহর ঘাঁটিতে যেন ইরানের কোনো অস্ত্রের মজুত গড়ে না ওঠে। সে জন্য ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অস্ত্রশস্ত্র বহনকারী সন্দেহজনক বিভিন্ন বিমান ও স্থল যানবাহনে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে, যার সব কটিই হয়েছে সিরিয়ার আকাশ ও ভূমিতে। আবার গত ডিসেম্বর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী উত্তর দিকে লেবানন সীমান্ত ঘেঁষে মাটির নিচে হিজবুল্লাহর ছয়টি সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস করেছে।

সিরিয়ার ভূমিতে ইরান-সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে দফায় দফায় ইসরায়েলি হামলার কোনো তেমন পাল্টা জবাব এখনো আসেনি সিরিয়া থেকে গুটি কয়েক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া ছাড়া। ইরান ও সিরিয়া কেউই সরাসরি সংঘাতে যেতে আগ্রহী নয়; যদিও দামেস্ক বিমানবন্দরে ইসরায়েলি হামলার পর সিরিয়া হুমকি দিয়েছে যে তেল আবিব বিমানবন্দরে পাল্টা আঘাত হানা হবে। বাস্তবে সেটা হওয়ার আশঙ্কা একেবারে ক্ষীণ। তা ছাড়া ইসরায়েলি হামলায় রাশিয়া থেকে পাওয়া সিরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কিন্তু সিরিয়ার মাটিতে ইরান নিজের অবস্থান ও সামরিক উপস্থিতি জোরদার করতে মরিয়া। বাশার আল–আসাদেরও এ বিষয়ে তেমন আপত্তি নেই। পারমাণবিক চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণ ও ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ইরানের জন্য এই অঞ্চলে কৌশলগত শক্তি ও উপস্থিতি বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। আর ইসরায়েলকে চাপে রাখার এত বড় সুযোগও হাতছাড়া করতে রাজি নয় ইরান। কাজেই আপাতত এ রকম হামলা ও ক্ষয়ক্ষতি সয়ে নিয়েও ইরান পিছু হটবে না।

বাড়ির পাশের শত্রুর বাড়িতে আরেক শত্রু এসে হাজির হলে যেকারোরই ঘুম হারাম হতে পারে। ইসরায়েলের অবস্থা এখন অনেকটা সে রকম। তবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই পরিস্থিতিটাকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতেও তৎপর হয়ে উঠেছেন। নিজ দেশে তিনি একের পর এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশি তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ জন্য তিনি পুলিশের ওপর খাপ্পা। এখন অ্যাটর্নি জেনারেলের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছেন যেন তিনি এই তদন্তের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন না করেন এবং আইনি পদক্ষেপ না নেন। নেতানিয়াহু ও তাঁর দল লিকুদ পার্টির সদস্যরা গণমাধ্যমের ওপরও চড়াও হচ্ছেন। এসবের উদ্দেশ্য হলো নিজের অনিয়ম-দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়া, নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে যাওয়া এবং পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হওয়া। এ বিষয়গুলো ইসরায়েলের বৃহত্তর সমাজ খুব ভালোভাবে গ্রহণ করছে না। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রিত্বের পাশাপাশি নিজে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় নেতানিয়াহু এখন সিরিয়ায় ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে নিয়মিত বিরতিতে হামলা চালাচ্ছেন নিজের ইচ্ছেমতো। এর মধ্য দিয়ে তিনি ইরানকে ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার উসকানি দিয়ে এক জুয়া খেলায় মেতেছেন। নিজের জনগণের ভেতর ইরানভীতি জোরদার করে বোঝাতে চাইছেন যে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল ও এর অধিবাসীদের সুরক্ষা তিনিই দিতে পারেন। এটা আগামী ৯ এপ্রিলের নির্বাচনের বৈতরণি পার হতে নেতানিয়াহুর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হবে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে ইসরায়েলের জনগণকে আগামী দিনগুলোয় আরও বেশি ইরানভীতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক
[email protected]