শূন্য পদ ও মেধাই হোক পদোন্নতির ভিত্তি

প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহ পালন করা হয়। জমকালো উদ্বোধন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত হয় কর্মসূচিটিতে। এবারও হয়েছে। সারা দেশে পুলিশ সুপার (এসপি) ও তদূর্ধ্ব পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম এটি। পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের কাজকে আরও সুচারুভাবে করার জন্য প্রতিবন্ধকতাগুলোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সরকারের। অকুস্থলেই এর কিছু সমাধান দেওয়া হয়। কিছু বিষয় পরীক্ষা–নিরীক্ষায় যায়।

পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন। পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের রেশন সুবিধাদি সম্প্রসারণ, যানবাহনের অপ্রতুলতা, আবাসন সংকটসহ বেশ কিছু সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো খুবই যৌক্তিক। সরকারের সামর্থ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব দ্রুত এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। দাবি করা হয়েছে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে তাদের মধ্য থেকে পদায়নেরও। দাবিটি প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচকভাবে বিবেচনার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তিনি পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছেন জনগণের ভোগান্তি যাতে না হয় সেদিকে জোর দিতে। একই রূপ নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতিও। বিষয়টি খুবই যৌক্তিক। পুলিশের কোনো কোনো সদস্যের এ বিষয়ে বিপরীতধর্মী কার্যক্রমে কত লোক ভোগান্তির শিকার হয় তা তাঁদের একটু ভাবা উচিত। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন পুলিশের মূল কাজ। এ কথাটা প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে বলেছেন।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, আইজিপির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাহিনীর কিছু সদস্যের মাদক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কোনো কোনো এসপি উল্লেখ করেছেন তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে অন্যত্র বদলি করা হলেও আবার চলে আসছে এ মধুচক্রে। বিষয়টির দুটো দিক আছে। পুলিশ বাহিনীর নিম্ন পর্যায়ের কোনো কোনো সদস্য আগেও কিছু অপরাধীর সঙ্গে যোগসাজশে সুবিধা নিতেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে এলে হতো তাঁদের সাজা। ন্যূনতম বদলি। এখনকার বিপজ্জনক দিকটা হচ্ছে তাঁদের কেউ কেউ নিজেরাই অপরাধ চক্রে জড়িত হচ্ছেন। মাদক ছাড়াও ছিনতাই, স্বর্ণ চোরাচালান ইত্যাদি কাজেও কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। ধরা পড়লে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। তবে এসব মামলার পরিণতি জানা যায় না বললেই চলে। দরকার রয়েছে এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর স্বপ্রণোদিত তথ্য পরিবেশনের। এতে জনমনে তাদের ভাবমূর্তি বাড়বে। আর মাদক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচ্ছিন্ন করার পরে আবার এসে জোটার বিষয়টি প্রশাসনিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। এমনটা চলছে মাঠ প্রশাসন, ভূমি ব্যবস্থাপনা, রেজিস্ট্রেশন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও। তাঁরা ওপর মহলের কারও আশীর্বাদতুষ্ট। আর বেশির ভাগই স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের স্নেহধন্য। বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত থানার ওসি কিংবা এসআই আর ইউএনও, এসি ল্যান্ডদের পদায়ন ও বদলি যেন তাঁদেরই ‘অধিকার’ হিসেবে অনেকটা বিবেচিত হচ্ছে। ফলে এই কর্মকর্তাদের আনুগত্যের পাল্লাও প্রভাবশালী মহলের দিকে ভারী।

দাবিদাওয়া এসেছে বেশ কিছু। দু–একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। যেমন একজন এসপি প্রস্তাব করেছেন জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভার সভাপতি তাঁদের করতে। বিষয়টি আইনের নিরিখে দেখা দরকার। এসপি পদটির ক্ষমতা পুলিশ আইন, পুলিশ প্রবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এসব বিধিবিধান স্পষ্টতই বলছে জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব এসপির। আর তেমনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে এসপি তা করবেন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) তত্ত্বাবধানে। সে জন্য জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি পদে ডিসিরা আছেন। এসব বিধিবিধান পরিবর্তন করে যদি পাশ্চাত্যের উন্নত বিশ্বের অনুসরণে ডিসি পদ বিলুপ্ত করা হয় তখন পুলিশকে কাজ করতে হবে কোনো না কোনো স্থানীয় সরকারের অধীনে। যেকোনো প্রশাসনিক ইউনিটে একজন সমন্বয়কারী থাকতেই হয়। জেলায় এ কাজটা ডিসিরা করছেন। ভারতেও তাই। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক একই রূপ। আমরা যদি ব্যবস্থাটা পাল্টাতেই চাই তাহলে তা শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে সম্ভব হবে। এর জন্য আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত প্রস্তুত আছে কি না, সেটা ভেবে দেখার বিষয়। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদকে বাস্তব অর্থে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিত্সক ও কর্মচারী সবাই জাতীয় সরকারের লোক। কার্যত কোনো বিষয়েই সর্বাংশেই স্থানীয় সরকারে হস্তান্তরিত হয়নি। সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এখনই তা হয়ে যাবে এমন মনে করার মতো যৌক্তিক কারণ নেই। তাই প্রচলিত ব্যবস্থাটি শুধু বহাল রাখা নয়, জোরদার করারও প্রয়োজন রয়েছে।

বেশ কিছু দাবি এসেছে পদোন্নতি নিয়ে। নির্বাচনের আগেও এসেছিল। দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের অনেকেই রয়ে গেছেন স্বীয় পদে (ইনস্টল)। যেমন অ্যাডিশনাল এসপি হিসেবে কাজ করছেন পদোন্নতি পাওয়া এসপি। কোনো কোনো এসপি পদে কাজ করছেন তেমনি পদোন্নতি পাওয়া অ্যাডিশনাল ডিআইজি। এমনটার রাস্তা দেখায় সচিবালয়ভিত্তিক পদগুলোর পদোন্নতি দিয়ে। তাঁদের সিংহভাগ প্রশাসনের কর্মকর্তা। এখানে বেশ কিছু অতিরিক্ত সচিব কাজ করছেন যুগ্ম সচিব এমনকি উপসচিবের ডেস্কে এবং অনেকটা একই অধিক্ষেত্রে। তেমনি অবস্থা যুগ্ম সচিব ও উপসচিবদেরও। এ–জাতীয় পদোন্নতিকে জনস্বার্থে বলা যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। অধীনস্ত পদে কাজ করছেন ওপরের পদের বেতন–ভাতাদি ও সুবিধা নিয়ে। এতে চেইন অব কমান্ডও শিথিল হয়ে যায়। কর্মকর্তাদের উদ্যমী করার চেয়ে চূড়ান্ত বিবেচনায় হতোদ্যমই করা হয়। শূন্য পদ ছাড়া এসব পদোন্নতি অন্যায্য ও ক্ষতিকর। কিন্তু তা ঘটেই চলেছে। পুলিশ এক দফা চেয়ে বেশ কিছু পেয়েছে। আরও চাইছে।

পদোন্নতি হওয়া উচিত শূন্য পদের ভিত্তিতে এবং মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে। পুলিশ বিভাগ তাদের পদোন্নতি সংকট কাটাতে আরও কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে। সে ক্যাডারটিতে ইদানীং যথেষ্ট মেধাবী কিছু কর্মকর্তা যোগ দিচ্ছেন। নিয়মিত তাঁদের একটি অংশকে সচিবালয়ের পদেও পাঠানো যায়। উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে থেকে যথাক্রমে ২৫ ও ৩০ শতাংশ কর্মকর্তা পদোন্নতি দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে প্রথমেই আসতে হবে উপসচিব পদে। পুলিশের পক্ষ থেকে এ সুযোগটা নেওয়ার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। অন্যান্য ক্যাডারের মতো তঁাদের কিছু নিয়মিত এ লাইনে এলে জনপ্রশাসন সমৃদ্ধ হবে। র‍্যাবের মহাপরিচালক পুলিশের লোক। প্রতিষ্ঠানটি পুলিশেরই অঙ্গ। সেখানেও পুলিশের যে কোটা, তা পূরণে তারা ততটা আগ্রহী নয় বলে জানা যায়। র‍্যাবে পুলিশ নিজস্ব কোটা পূরণের জন্য তত্পর হলে পদোন্নতি ও পদায়ন সমস্যারও কিছুটা সমাধান হয়।

পুলিশ সপ্তাহের বিভিন্ন পর্বে অনেক কথা হয়। নানা প্রস্তাব আসে। কিছু অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবায়ন করা সংগত। আবার এমন কিছু প্রস্তাব আসতে পারে, যেগুলো তেমন জোরালো বা প্রতিনিধিত্বশীল নয়। প্রত্যাশা রইল পুলিশ বাহিনী সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কথা ও কাজে আরও আন্তরিক হবে। তাদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়াও সরকারের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]