দুধ-দইয়ে ক্ষতিকর উপাদান

বাজারে সহজলভ্য গরুর দুধ, প্যাকেটজাত দুধ, দই ও গোখাদ্যে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক, নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের উপাদান ও বিভিন্ন অণুজীব পাওয়ার তথ্য ভীতিকর। এ বিষয়ে ১৫ দিনের মধ্যে সারা দেশের অবস্থার ওপর একটি জরিপ প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আসলে স্বাস্থ্য প্রশাসনের তরফে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা ছাড়াই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা কতটা সমীচীন ছিল, হাইকোর্টের রুল সেই প্রশ্ন সামনে এনেছে। 

সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) প্রধান অধ্যাপক শাহনীলা ফেরদৌসীর নেতৃত্বাধীন একটি টিম জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং ডাচদের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় গবেষণাকর্মটি সম্পন্ন করেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সামনেই ওই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করা হয়। ঢাকাসহ চারটি জেলার ২৭টি উপজেলা বা থানা থেকে সংগ্রহ করা নমুনার ভিত্তিতে গবেষণা করা হয়েছে। সুতরাং এর ফল সারা দেশে দুগ্ধজাত খাদ্যের ভোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করবে; তাঁরা এখন কী করবেন, কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করলে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যেতে পারে, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। এ দায়িত্ব গবেষকদের নয়, সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৯-১০০ শতাংশ গোখাদ্যে কীটনাশক, সিসা ও আফলাটক্সিন গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রা পাওয়া যায়। গরুর দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯ শতাংশ দুধে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কীটনাশক, ১৩ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিন এবং ১৫ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় সিসা পাওয়া যায়। ৯৬ শতাংশ দুধে মেলে বিভিন্ন ক্ষতিকর অণুজীব। এমনকি বলা হয়েছে, গাভির বাঁট থেকে বাছুরের দুগ্ধপানও অনিরাপদ।

বাজারে ব্যাপকভাবে বিক্রি হওয়া প্যাকেটজাত দুধের ৩১টি নমুনায় ৩০ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি হারে আছে টেট্রাসাইক্লিন। দইয়ের ৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করে একটিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা আর ৫১ শতাংশ নমুনায় মিলেছে বিভিন্ন অণুজীব। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল, শিশুদের বাজারের দুধ খাওয়ানো উচিত কি না? কিন্তু গবেষকেরা এর কোনো সদুত্তর দেননি। বলা হয়েছে, ‘আমরা এ দুধ খেয়েই বেঁচে আছি।’ কিন্তু বিষয়টি এভাবে এড়িয়ে যাওয়ার মতো হালকা নয়। বিশেষত শিশুস্বাস্থ্যের জন্য এটি গুরুতর বিষয়। এ বিষয়ে অবশ্যই সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের বক্তব্য থাকা উচিত।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে ডেইরি শিল্পের অনেক অগ্রগতি ঘটেছে, দুধ ও দুধজাত খাবারের বিপণনব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমাদের আরও অগ্রগতির সুযোগ আছে। কিন্তু এসব খাদ্যের গুণগত মান রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা না থাকলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকে যাবে। সে জন্য দুধ ও দুধজাত খাবার উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত যথাযথ নজরদারির স্থায়ী ও নিয়মিত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রথমেই নজর দিতে হবে গোখাদ্য ও গরু লালনপালনের দিকে। যে গরুকে কীটনাশক বিষ, সিসা, আফলাটক্সিন ইত্যাদি ক্ষতিকর উপাদানের তৈরি খাবার খাওয়ানো হবে, তার দুধেও সেসব উপাদান থাকবে। তাই গরুর খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। আর দুধ সংগ্রহ ও বাজারজাত করার প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতাসহ সব রকমের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

গত এক বছরে ভেজাল খাদ্যের দায়ে চৌদ্দ শর বেশি মোবাইল কোর্ট সোয়া কোটি টাকার বেশি জরিমানা এবং ২ হাজার ৩শর বেশি মানুষকে দণ্ড দিয়েছেন। আসলে প্রয়োজন নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে ডেইরি শিল্পকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখা। নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা বিশেষভাবে প্রয়োজন।