সড়কে হর্ন ও সাইরেনবাজি

কিছুকাল আগে ইংল্যান্ড থেকে এক বয়স্ক আত্মীয় ঢাকায় বেড়াতে এসে কিছুদিনের জন্য আমাদের বাসায় অতিথি হলেন। আমাদের একটা ছোট বারান্দা আছে। প্রায় সকালেই সেখানে বসে চা খাই, পত্রিকা পড়ি, মাঝেমধ্যে রেডিওতে গান শুনি। দ্বিতীয় সকালে অতিথিও আমার সঙ্গে বসলেন, চা খেলেন। পরে একসঙ্গে গেলাম নাশতার টেবিলে। পরের সকালে একই রুটিন। তৃতীয় সকালে তিনি বারান্দায় বসতে এলেন না। নাশতার টেবিলে যখন দেখা হলো, কথাচ্ছলে বললাম, ‘সকালে বোধ হয় দেরিতেই ঘুম ভেঙেছে?’ একটু বিরক্তিমাখা স্বরে ভদ্রলোকের 

উত্তর, ‘তোমার বারান্দায় বসলে হর্নের বিকট শব্দে মাথা ধরে যায়।’

কথাটা খাঁটি। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে গাড়ির হর্নের বিকট শব্দের যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তাতে যেকোনো লোক ভিরমি খেতে পারে। অধমের অভ্যাস হয়ে গেছে। অবশ্য সকালে কাউকে টেলিফোন করলে অপর প্রান্ত থেকে প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তুমি কি রাস্তায়? সদর্পে উত্তর দিতে হয়, জি না, সম্পূর্ণ নিজ বাসগৃহে। স্পষ্টতই রাস্তা ও বাসা হয়েছে বিলীন হর্নের মাধুর্যে।

বয়স্ক আত্মীয়টি ৬০ বছরের মতো ইংল্যান্ডে থাকেন। আমার বাসায় চার দিন টিকলেন না। অন্য এক আত্মীয়ের বাসায় চলে গেলেন। বলে গেলেন, ওর ফ্ল্যাট তো আটতলায়, শব্দ নিশ্চয় কম। পরে জেনেছি, তিন সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে আসা এই বাঙালি আত্মীয়টি ১০ দিনের মাথায় ইংল্যান্ডে ফিরে গেছেন। শব্দ–রাক্ষসের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। আমরা যাব কোথায়?

আমাদের গাড়িচালকের একটা বিশ্বাস ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সেটা হলো যানজট যত বেশি, হর্ন তত জোরে বাজালে সামনে থেমে থাকা প্রতিটি গাড়ি আরব্য উপন্যাসের চিচিং ফাঁকের মতো সরে গিয়ে রাস্তা খুলে দেবে। তাই যানজটে আটকে থাকা গাড়ির ভিড় দেখলেই পেছনের গাড়ির চালকের হাত সম্ভবত তার অজান্তেই হর্ন চাপতে থাকে। একটা ধারণাও সম্ভবত প্রকট হচ্ছে। সেটা হলো আমার গাড়ি যত বড় তার হর্নের তীক্ষ্ণতা, বিকটতা আর আশপাশের সব মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার ও হৃৎকম্পন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতাটাও তত বেশি হতে হবে।

আরও আছে। আগে সাইরেন থাকত শুধু অ্যাম্বুলেন্সে এবং অতি প্রয়োজনীয় ও জরুরি কাজে নিয়োজিত বিশেষ কিছু সরকারি গাড়িতে। ঢাকা শহরের মতো অ্যাম্বুলেন্সের এত উৎপাত আশপাশের দেশগুলোর বড় বড় শহরে কোথাও নজরে পড়েনি। কয়েক মাস আগে ব্যাংককে গিয়েছিলাম। ব্যাংককের রাস্তায় রাস্তায় বেশ ঘোরাঘুরি করতে হয়েছিল। একটিবারও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনিনি। ব্যাংককে নির্ঘাত হাসপাতাল নেই, অথবা থাকলেও তাদের অ্যাম্বুলেন্সের সার্ভিস নেই অথবা ব্যাংককবাসীর জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য সাইরেনওয়ালা অ্যাম্বুলেন্সের দরকার পড়ে না। আর ঢাকা শহরের রাস্তায় ১০ মিনিট চলবেন অথচ অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে কান একবারও ঝালাপালা হবে না, সেটা কি হয়!

তদুপরি, কালো কালো রঙের দানবগোছের কালো রঙে আবৃত জানালা ও উইন্ডস্ক্রিনের সরকারি গোছের প্রতিটি গাড়িতেই এখন বোধ হয় সাইরেন অথবা সাইরেন জাতের হর্ন লাগানো থাকে। চান্স পেলেই রাস্তায় বসে বসে বাজাতে থাকে। ভাবখানা এই, বেটা দেখিস না, আমি কী হনুরে। ছাড় ছাড়, আমার জন্য রাস্তা ছাড়। এখন আমরাই তো দেশের মালিক।

২.
সড়ক দেখার কেউ আছেন বলে তো মনে হয় না। জাতির কত বড় দুর্ভাগ্য যে ‘সড়কে মৃত্যুর মিছিল’ অভিব্যক্তিটি আজকাল নিতান্তই প্রাত্যহিক ও মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই টেলিভিশনে শুনতে হয় বা খবরে পড়তে হয়, সড়কে মৃত্যুর মিছিল। দেখার কেউ আছে বলে ঠাওর করতে পারছি না।

একজন বোধ হয় আছেন। সরকারি ছুটির দিনে টেলিভিশনে দেখি, উনি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিএনজি অটোরিকশা আর বাস-ট্রাকের চালকদের লাইসেন্সসহ গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করছেন। আর বারবার ঘোষণা দিচ্ছেন, এই–জাতীয় অভিযান চলবে। বিআরটিএর সাধারণ কর্মচারী বা ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর বা সাব–ইন্সপেক্টরের এত মহত্ত্ব, নাকি মধু। তা গো আগে বুঝিনি। মাঝেমধ্যে তাঁকে আরেকটি ঘোষণা দিতে টেলিভিশনের পর্দায় মোলাকাত মেলে। এই যে দৃশ্যমান হলো। পদ্মা সেতুর একেকটা স্প্যান বসে আর ঘোষণা আসে, দেখলেন দেখলেন,
দৃশ্যমান হচ্ছে। অবশ্য আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁকে পালন করতে হয়, সেটা হলো বিএনপিকে হেদায়েত করা। তাঁর কাছে নিশ্চয় গুপ্ত খবর আছে। বিএনপি তাঁর হেদায়েত-বাণী গোগ্রাসে গিলছে। নেতারা বাস্তবায়নে উদ্‌গ্রীব। তবে বিএনপি কর্মীদের এখনো বুঝিয়ে উঠতে পারছে না। তবে অধমের দৃঢ় বিশ্বাস, এই উপদেশগুলো মর্মে-কর্মে ধারণ করলে বিএনপি নিঃসন্দেহে একটা ভালো রাজনৈতিক দল হয়ে যাবে।

কিন্তু শব্দদূষণের কী হবে? সাইরেনবাজি ঠেকাবে কে? আর মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিলে আত্মাহুতি দিতে হবে আর কতজনকে?

৩.
এবং বাংলাদেশকে হারাল কোন পাজিটা? দেশটার নাম বুরুন্ডি। মধ্য আফ্রিকার ছোট দেশ। কমবেশি ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তন। লোকসংখ্যা এক কোটির কিছু বেশি। স্বাধীনতা ১৯৬২ সালে। কিছুটা আমাদের মতোই চার বছর পরপর একদলীয় শাসন, মারামারি-কাটাকাটি, ক্যু আর পাল্টা ক্যু, সামরিক শাসন, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই দেশের দুই প্রধান গোষ্ঠী হুতু আর তুতসির মধ্যে হানাহানি, গণহত্যা, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। ১৯৯৩-৯৪–এ নিহতের সংখ্যা কমবেশি আট লাখ। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট পিয়েরে কুরুনজিজা। প্রথম নির্বাচিত হন ২০০৫ সালে, দ্বিতীয়বার ২০১০ সালে। ২০১৫ সালে কথা উঠল সংবিধান অনুযায়ী তৃতীয়বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তিনি অযোগ্য। মানলেন না। কুরুনজিজা প্রার্থী হলেন। বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করল। ধারণা করছি ওই দেশের নির্বাচন কমিশন ও সরকারি দল বলেছিল যে সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসা নির্বাচন কমিশনের কাজ না, সরকারেরও কাজ না। ২০১৫ সালের মে মাসে কুরুনজিজা বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বার মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। তিনি দেশটির উন্নতি অব্যাহত রেখেছেন। ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থার মূল্যায়নে পরিবেশগতভাবে বিশ্বের নিকৃষ্টতম ১৮০তম দেশটি হলো বুরুন্ডি। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রথম আলোর প্রধান খবরে (‘পরিবেশদূষণে টানা অবনতি’) পরিবেশগতভাবে নিকৃষ্টতম দেশ হিসেবে বুরুন্ডির নাম আসেনি। ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১৭৯তম। শেষতক বুরুন্ডির কাছে হেরে গেলাম। পাজি দেশটার কারণে আমরা অল্পের জন্য নিকৃষ্টতম দেশ হতে পারলাম না।

৪.
মাঝেমধ্যে সন্ধ্যা আর রাতে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা এখন ‘বিপজ্জনক’। পরিবেশগতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের অন্যতম ঢাকা। একটুর জন্য ফার্স্ট হতে পারছি না। লোকমুখে শুনেছি, হলফ করে বলতে পারব না। যাচাইও করিনি। পাঠক বিশ্বাস করতে পারেন, না–ও করতে পারেন। তবে লোকমুখে যা শুনেছি তা হলো, ঢাকার বেশ কয়েকটি বিদেশি দূতাবাস শূন্য পদ পূরণের জন্য লোক পাচ্ছে না। সহজে কেউ ঢাকায় আসতে চায় না। আমার বয়স্ক আত্মীয়ের মতো ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়। বেশি বেতনেও নাকি কাজ হচ্ছে না।

উন্নয়নের বাণী ও বুলি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা ও করার কেউ আছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না। ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর থেকে জানলাম, দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিবেশমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর পরিবেশ অধিদপ্তরে যেতে সময় লেগে গেল এক মাস। অর্থাৎ মন্ত্রীদ্বয় শপথ নেওয়ার পর ১১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার গেলেন পরিবেশ অধিদপ্তরে।

চারদিকে ভীষণ ধস। সবাই মিলে আমরা শুধু দেখছি আর বলছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

ড. শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক