দুর্যোগ মোকাবিলা

সরকারি হাসপাতাল বললেই আমাদের চোখে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার ছবি ভেসে ওঠে। চিকিৎসকের সংকট, কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা, ওষুধের ঘাটতি নিয়ে প্রায়ই পত্রপত্রিকায় খবর ছাপা হয়। কোনো কোনো সময়ে প্রতিকার পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ সময় কর্তৃপক্ষ বোবা ও কালার ভূমিকায় অভিনয় করে থাকে। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন লাগার পর সেখানকার চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতার সঙ্গে রোগীদের সরিয়ে নিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে আবার তাদের অধিকাংশকে ফিরিয়ে এনেছেন, তা প্রশংসনীয়।

অগ্নিকাণ্ডের সময় হাসপাতালে ১ হাজার ১৭৪ জন রোগী ছিল, যার মধ্যে ৫২৬ জন পুরুষ, ৫৭৬ জন নারী ও ৭২টি শিশু। এই বিরাটসংখ্যক রোগীকে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া ও ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। যেসব হাসপাতালে তাদের সাময়িকভাবে নেওয়া হয়েছিল, সেসব হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও এ ব্যাপারে সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। সহযোগিতা ছিল সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। এটি অত্যন্ত স্বস্তির কথা যে এত বড় দুর্ঘটনার পরও কেউ আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এবং হাসপাতালের ক্ষতি কম হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনটি বিভাগ ছাড়া হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগের কাজকর্ম স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

ডেইলি স্টার-এর খবর অনুযায়ী, যখন হাসপাতালে আগুন লাগে তখন চিকিৎসক নূর আহমদ তালুকদার অন্যদের নিয়ে তিনতলায় রোগীর অস্ত্রোপচার করছিলেন। মাঝপথে বিদ্যুৎ চলে গেলে তিনি সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনের আলো দিয়ে অস্ত্রোপচার শেষ করেন। অপারেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে নূর আহমদ তালুকদার বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানান এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তাঁরা রোগীদের সরানোর কাজে নেমে পড়েন। ইতিমধ্যে দমকল বাহিনীর সদস্যরা এবং আশপাশে বিভিন্ন স্তরের মানুষও উদ্ধার অভিযানে যোগ দেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুক্রবারের ছুটি বাতিল করেছে। এতে দায়িত্বশীলতার প্রমাণ মিলেছে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এ ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা নিতে পারি তা হলো, হাসপাতালের মতো স্থাপনার জন্য নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রাথমিক তদন্তে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগার কথা বলা হয়েছে। হাসপাতালের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যাতে কোনো রকম ত্রুটি না থাকে। বিদ্যুৎ–ব্যবস্থার সামান্য ত্রুটি থেকে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। দ্বিতীয় শিক্ষা হলো সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের নির্মাণশৈলীর কারণে রোগীদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়া গেছে। আশপাশের সড়কও ছিল প্রশস্ত। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা অন্য কোনো সরকারি হাসপাতালে সেটি সম্ভব হতো কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তদুপরি সড়ক যোগাযোগও ভঙ্গুর। অতএব, প্রতিটি হাসপাতাল এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে রোগীদের দ্রুত আনা-নেওয়া করা যায়। হাসপাতালের চারদিকে খোলা জায়গা থাকা দরকার, যা রাজধানীর খুব কম হাসপাতালেই আছে। ভবিষ্যতে হাসপাতাল নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে আশা করি।

তৃতীয় শিক্ষাটি হলো, সবার সম্মিলিত চেষ্টা থাকলে যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। মাত্র দুই দিনের মধ্যে প্রায় পুরো হাসপাতাল সচল হয়েছে এবং রোগীরাও হাসপাতালে ফিরে এসেছে। এতে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যেমন আন্তরিক চেষ্টা ছিল, তেমনি বিভিন্ন স্তরের মানুষ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা আবারও প্রমাণ করলেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য’।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের রোগীদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়া এবং আবার ফিরিয়ে আনার এই দৃষ্টান্ত অনুসরণীয় হতে পারে।