হলফনামা না অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা?

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রার্থীদের দাখিল করা হলফনামার ভিত্তিতে আমরা প্রতিনিয়তই অনেক প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখেছি। দেখেছি এসব তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দর্শক-পাঠকদের অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থীদের প্রদত্ত হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ প্রথম আলোতে (৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) প্রকাশের পর ভোটারদের প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ওপর পাঠকের ৮৫টি মন্তব্য প্রকাশিত হয়, যার প্রায় সবগুলোই ছিল নেতিবাচক। তাই প্রার্থীদের হলফনামা প্রদানের বিষয়টি বর্তমানে যেন একটি অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে, এগুলো ভোটারদের সামনে প্রার্থীদের সঠিক তথ্য তুলে ধরতে এবং তাদের ‘ইনফর্মড ডিসিশন’ নিতে সহায়তা করতে পারছে না।

প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা আকারে তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খতিয়ান, আয়ের উৎস, নিজেদের এবং নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদ ও দায়দেনার তথ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো ভোটারদের ক্ষমতায়িত করা, যাতে তাঁরা ভোটকেন্দ্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভোটারদের এ ধরনের তথ্যভিত্তিক ক্ষমতায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মতে, ‘...নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভোটাররা না জানে। তাদের “এ” কিংবা “বি”-এর পক্ষে ভোট দেওয়ার কোনো ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, নিরপেক্ষও হবে না।’ আদালত আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র যাতে গুন্ডাতন্ত্র এবং উপহাসে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের তথ্য পাওয়া জরুরি।’ [পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০০৩) ৪ এসসিসি]। তাই হলফনামা প্রার্থীদের জন্য আমলনামার মতো কাজ করার কথা। কারণ, তথ্য গোপনের জন্য মনোনয়নপত্র, এমনকি নির্বাচন বাতিল হওয়ার বিধান আইনে রয়েছে।

তবে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির এ অধিকার সহজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেকেরই স্মরণে থাকার কথা যে ২০০৫ সালে বিচারপতি আবদুল মতিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে আট ধরনের ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেন। আদালত এসব তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে নাগরিকদের বাক্স্বাধীনতার অংশ হিসেবে রায় দেন। কারণ, নাগরিকের ভোট প্রদান তার বাক্স্বাধীনতারই প্রতিফলন।

আদালতের এই রায় ঘোষণার পর থেকেই আমরা ‘সুজন’-এর পক্ষ থেকে এটি বিভিন্ন উপনির্বাচনে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিই, যদিও বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন আমাদের হলফনামার কপি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে বহু দেনদরবারের পরিপ্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জ-৩ আসনের উপনির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা আমাদের প্রার্থীদের হলফনামার একটি সারাংশ প্রদান করেন, যার ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো একটি তুলনামূলক চিত্র তৈরি করে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই আমরা তা ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করি। প্রসঙ্গত, এই রায়ের প্রথম শিকার হন কাজী সিরাজুল ইসলাম, যিনি অষ্টম সংসদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়ে বিএনপিতে যোগদান করে সংসদ সদস্যপদ হারান। পরবর্তী সময়ে উপনির্বাচনে তাঁকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং তিনি তাঁর হলফনামায় সোনা চোরাচালানের একটি মামলা গোপন করেন (প্রথম আলো, ৯ আগস্ট ২০০৫), যা প্রকাশিত হলে বিএনপি তাঁর মনোনয়ন বাতিল করে।

এরপর ২০০৬ সালে হঠাৎ করে এক সাংবাদিকের টেলিফোন থেকে জানতে পারি যে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে গোপনে আপিল করা হয়েছে এবং ‘লিভ টু আপিল’ প্রধান বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চে একতরফা শুনানির মাধ্যমে গৃহীতও হয়েছে। জনৈক আবু সাফার পক্ষে, যিনি মূল মামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, ব্যারিস্টার ওমর সাদাত কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সহায়তায় আপিলটি দায়ের করেন। আপিলে দাবি করা হয় যে জনাব সাফা একজন বিত্তবান অতি জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী এবং আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী, কিন্তু শৈশবে দারিদ্র্যের কারণে তিনি মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাই হলফনামার মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রকাশ পেলে তিনি নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অসুবিধাজনক অবস্থানে পড়বেন।

আপিলটি দায়ের করা হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। মামলার মূল বাদীদের আপিলের ব্যাপারে নোটিশ দেওয়া হয়নি; মামলার নথিতে বাদীদের নাম, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট—এই ঠিকানা লিখে পাঠানো হয়, যা তাঁদের কাছে পৌঁছায়নি। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে কোনো নোটিশও দেওয়া হয়নি। আপিলকারী একজন তৃতীয় পক্ষ হলেও, তৃতীয় পক্ষকে সাধারণত আপিল করতে দেওয়া হয় না এবং শুনানিতে মূল মামলার বাদীদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও লিভ টু আপিলটি একতরফাভাবে গৃহীত হয়। এ খবর শোনার পর মূল বাদীদের পক্ষ থেকে ‘কেভিয়েট’ দেওয়া হয়, যাতে পরবর্তী শুনানি তাঁদের অনুপস্থিতিতে না হয়।

এরপর ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার মাত্র দুই দিন আগে, আপিলকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি জয়নুল আবেদীন আবারও একতরফা শুনানির ভিত্তিতে হলফনামা প্রদানের ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। প্রসঙ্গত, আপিলকারী তাঁর নিজের হলফনামা প্রদানের ওপর স্থগিতাদেশ চাইলেও স্থগিতাদেশটি দেওয়া হয় সব প্রার্থীর ক্ষেত্রে। উল্লেখ্য, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবিশ্বাস্য গতিতে নির্দেশনাটি নির্বাচন কমিশনে পৌঁছে যায়, যা একই দিনে কমিশন রিটার্নিং অফিসারদের কাছে প্রেরণ করে। ফলে ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হলফনামা ছাড়াই মনোনয়নপত্র জমা দেন।

পরবর্তী সময়ে আবু সাফা সম্পর্কে সন্দ্বীপে তাঁর গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে আমরা জানতে পারি যে তিনি তাঁর আপিলের আরজিতে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ অসত্য। তিনি একজন পাকিস্তানফেরত সৈনিক এবং ঢাকার আশপাশে নৈশপ্রহরী হিসেবে কর্মরত। তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে পরিত্যাগ করে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এবং আমরা তাঁর স্ত্রী, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও প্রতিবেশীদের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ করে ঢাকায় নিয়ে আসি।

এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ ড. কামাল হোসেন আমাদের পক্ষে আপিলের গ্রহণযোগ্যতা চ্যালেঞ্জ করে জনাব সাফার জালিয়াতির বিষয়টি উত্থাপন করতে গেলে আপিল বিভাগের পূর্ণ বেঞ্চ তাতে বাদ সাধেন এবং হাইকোর্টের রায় খারিজ করে দেন। এতে ড. হোসেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন যে এ ধরনের অবিচারের জন্য বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়নি এবং সংবিধানও রচিত হয়নি। তিনি রায়টি প্রত্যাহার করা না পর্যন্ত আদালত কক্ষ ত্যাগ না করার ঘোষণা দেন। তাঁর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একই দিনে আদালত রায়টি প্রত্যাহার করে এই নাটকীয়তার অবসান ঘটান।

এরপর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন হলে প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ আবু সাফাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন, যা তাঁর আইনজীবীরা পালন করতে ব্যর্থ হন। এমনি প্রেক্ষাপটে আদালত ১১ ডিসেম্বর ২০০৭ আপিলটি খারিজ করে দেন এই যুক্তিতে যে যেহেতু আপিল আবেদনে একজন কাল্পনিক ব্যক্তির নাম এবং ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তাই এটি আপিলই হয়নি। এভাবে আদালতের নির্দেশে প্রার্থী সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত হয়। তথাপিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে তা প্রদানে বিভিন্ন সময়ে অনেক টালবাহানা করা হয়। এমনকি মহাজোটের পক্ষ থেকে একাধিক ব্যক্তি এই বিধান বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনে ধরনা দেন।

নিঃসন্দেহে প্রার্থীদের পক্ষে ভোটারদের অবগতির জন্য তথ্য প্রকাশের বিধানটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু প্রার্থীরা তথ্য গোপন করলে বা ভুল তথ্য দিলে ভোটাররা বিভ্রান্ত, এমনকি তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্যই ভুল হয়। তাই যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করার মাধ্যমে কমিশনের তথ্যগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। আরও আবশ্যক হলফনামার ছকে কিছু পরিবর্তন আনার। দুর্ভাগ্যবশত বহু চেষ্টা করেও আমরা কমিশনকে এ ব্যাপারে রাজি করাতে পারিনি, যদিও এর মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন বহুলাংশে কলুষমুক্ত হতে পারত।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক