নদী রক্ষা হবে কি?

অবৈধ দখল ও দূষণ কবলিত করতোয়া নদী উদ্ধারে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের দাবিতে টিআইবির সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) আয়োজনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বর, বগুড়া, ১৮ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সোয়েল রানা
অবৈধ দখল ও দূষণ কবলিত করতোয়া নদী উদ্ধারে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের দাবিতে টিআইবির সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) আয়োজনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বর, বগুড়া, ১৮ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সোয়েল রানা

রংপুর বিভাগের আটটি জেলায় দুই শতাধিক নদীর মধ্যে প্রায় ১৬০টি নদী সম্পর্কে আমার সরেজমিন খবর নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। গত কয়েক বছরে আমি নদীগুলো ঘুরে দেখেছি এবং নদীর পাড়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে নদীগুলোর অবস্থা জানার চেষ্টা করেছি। নদীর পাড়ে যাওয়ার কারণে নদীর প্রকৃত সংকট জানার সুযোগ হয়েছে। রংপুর বিভাগের কোন নদী দখলের শিকার, কোন নদী দূষণের শিকার—তা মোটামুটি প্রত্যক্ষ করেছি।

রংপুর বিভাগে প্রকৃত অর্থে এমন একটি নদীও নেই, যে নদীটির স্বাস্থ্য ভালো আছে। রংপুরের আটটি জেলার মধ্যে পঞ্চগড়ে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় ২০টি, দিনাজপুরে প্রায় ৩০, নীলফামারীতে প্রায় ২৫, রংপুরে ২৮, গাইবান্ধায় প্রায় ২০, কুড়িগ্রামে প্রায় অর্ধশত এবং লালমনিরহাটে প্রায় ১৫টি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি নদী আছে, যা একাধিক জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। এ বিভাগে যে নদী আছে, তার কোনোটি শীর্ণকায়, কোনোটির তলদেশ ভরাট এবং কোনোটি দখলে পড়ে হাঁসফাঁস করছে। কোথাও উন্নয়নের নামে বলি হয়েছে নদী, কোথাও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দখলদারি নিয়েছে। অনেক স্থানে নদীসংলগ্ন জমির মালিক নদী দখল করেছেন। এভাবে রংপুর অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর প্রাণ ওষ্ঠাগত।

রংপুর বিভাগের নদীগুলোর মধ্যে যে কয়েকটি নদীর পাশে শহর আছে, সেগুলোতে দূষণও আছে। কিন্তু যে নদীগুলোর পাশে শহর গড়ে ওঠেনি, সে নদীগুলো দূষণের শিকার নয়। শিল্পকারখানা খুবই কম থাকার কারণে কারখানার বর্জ্য দূষণের ঘটনা খুবই কম ঘটেছে। পঞ্চগড়ের করতোয়া, দিনাজপুরের পুনর্ভবা, একই জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার নলশীসা, গাইবান্ধার ঘাঘট, নীলফামারীর বামনডাঙ্গা, একই জেলার সৈয়পুরের খড়খড়িয়া, ঠাকুরগাঁওয়ের টাঙন, বোদা উপজেলার পাথরাজ, রংপুর সদর উপজেলার শ্যামাসুন্দরী, ইছামতি, ঘাঘট, খোসকা ঘাঘট এবং বদরগঞ্জ উপজেলার শাখা চিকলি নদী দূষণের শিকার। এসবের মধ্যে শ্যামাসুন্দরী, পাথরাজ, শাখা চিকলি ও নলশীসার অবস্থা সবচেয়ে করুণ। সব নদী দূষণের শিকার না হলেও দখল আছে সব নদীতে। নদীপাড়ের মানুষের ভাষ্য অনুযায়ী, নদীগুলো অর্ধশত বছর আগেও অনেক বড় ছিল, নদীর বৈশিষ্ট্য অন্য রকম ছিল। এখন এই নদীর চরিত্র বদলে গেছে।

কুড়িগ্রামের জিঞ্জিরাম, পঞ্চগড়ের তালমা, দিনাজপুরের আত্রাই নদীতে রাবার ড্যাম দিয়ে ধান চাষাবাদের মাধ্যমেও নদীর ক্ষতি হচ্ছে। ঠাকুরগাঁওয়ের টাঙন এবং তিস্তায় সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে বোরো মৌসুমে চাষাবাদ বন্ধ করা জরুরি। তা না হলে শীতকালে এ দুটো নদী ব্যারাজের ভাটিতে মরে যাচ্ছে। রংপুর বিভাগের অনেক নদীর প্রাণ হচ্ছে অসংখ্য বিলের পানি। এখন হাজার হাজার কালভার্ট, সেতুর মুখ বন্ধ করে মাছসহ ধান চাষ করার কারণে সেই বিলের সঙ্গে নদীর সংযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এখন অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা যায়। বিলের পানি যাবে নদীতে, নদীর পানি সমুদ্রে। কিন্তু এই সংযোগগুলো এখন অনেক স্থানে আর নেই।

বর্তমানে চলছে বোরো মৌসুম। এই মৌসুমে রংপুর বিভাগের প্রায় সব নদীতে অবৈধভাবে ধান চাষ করা চলছে। অনেক নদীতে সবজির চাষ করা হয়েছে। যাঁরা চাষাবাদ করছেন, তাঁরা ধীরে ধীরে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে জমির মালিক হন। অনেক নদী আছে, যেগুলোর ওপর সরকার আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করেছে। যেমন কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার নদীর ওপর, কুড়িগ্রাম জেলা সদরের পাঁচগাছির ছড়া নদীর ওপর সেতু ছাড়াই সড়ক নির্মাণ করে নদী দুটোকে হত্যা করা হয়েছে। উলিপুর বুড়িতিস্তা এবং ঘাঘটের উৎসমুখ বন্ধ করে নদীর সর্বনাশ করা হয়েছে।

এ অঞ্চলের অনেক নদীর খনন জরুরি। অনেক নদীর পানির প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য সব ব্রিজ-কালভার্টের মুখ উন্মুক্ত করার বিকল্প নেই। দূষণ বন্ধ করতে হবে। নদীর যে স্থান দখল করে স্থাপনা গড়ে উঠেছে, সেগুলো দখলমুক্ত করে দখলদারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেই নদী খনন করতে হবে। আন্তসীমান্ত নদীগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে এমন ক্ষমতা দিতে হবে যে তার নির্দেশনা জেলা–উপজেলা প্রশাসন বাস্তবায়ন না করলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। সরকার যদি নদীর দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়, তাহলে নদী রক্ষা করা কঠিন হবে না। এ জন্য শুধু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নদীর পক্ষে থাকলে অল্পসংখ্যক দখলদার সরকারের ওপর নাখোশ হলেও কোটি কোটি মানুষ সরকারের এ চেষ্টাকে সমর্থন করবে।

রংপুর বিভাগের নদীর যে করুণ অবস্থা দেখেছি, সেই অবস্থা থেকে নদীগুলোকে অনেকটাই প্রাণ দেওয়া সম্ভব। নদীর সঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয় যুক্ত। কৃষি মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। দেশের অসংখ্য নদী অবৈধভাবে ব্যক্তিমালিকানায় গেছে। এগুলোর সঙ্গে অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তা জড়িত। হাইকোর্ট সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করার জন্য যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা যদি পালন করা যায়, এতে নদী বোধসম্পন্ন একটি প্রজন্ম তৈরি হবে।

হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার ২০১৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করেছে। সরকার যখন নদী রক্ষা কমিশনের আইন প্রণয়ন করেছে, তখন মাত্র ১৩টি ধারায় সরকারকে সুপারিশ করার ক্ষমতা দিয়েছে। বাস্তবিক অর্থে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) চেয়ে অনেক কম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে। একজন ইউএনওর নদী রক্ষা করার জন্য যে ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ আছে, সেই সুযোগ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নেই। ফলে সভা-সেমিনার করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জেলা প্রশাসক আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নদী রক্ষায় তাগিদ দিচ্ছে। হাইকোর্ট জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক ঘোষণা করেছেন। শুধু অভিভাবকত্ব দিয়ে নদী রক্ষা হবে না। এর জন্য আইন সংশোধন করে এই কমিশনকে জনবল কাঠামোতে এবং ক্ষমতায় স্বয়ংসম্পন্ন করে তুলতে হবে। নদী রক্ষা অসম্ভব নয়। কিন্তু সে জন্য সরকারের সমন্বিত চেষ্টা থাকতে হবে। 

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]