ফায়ার কোড লঙ্ঘনে কারও কখনো শাস্তি হয়নি

মো. মাকসুদ হেলালী
মো. মাকসুদ হেলালী
>
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. মাকসুদ হেলালী ন্যাশনাল ফায়ার কোড প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান 


প্রথম আলো : ন্যাশনাল ফায়ার কোডের প্রণেতা এবং অগ্নিনির্বাপণ–সংক্রান্ত একাধিক সরকারি কমিটির সদস্য হিসেবে আপনি কীভাবে চকবাজার ট্র্যাজেডিকে দেখছেন?

মো. মাকসুদ হেলালী: সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যার যা দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল, সেগুলো তারা পালন করেনি। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের একটি অংশ হলো ফায়ার কোড। সেখানে বিভিন্ন ধরনের বাধানিষেধের কথা রয়েছে। যদিও বিস্তারিত নেই। কোডে সেটা থাকার কথাও নয়।

প্রথম আলো: আবাসিক এলাকার মধ্যে রাসায়নিক গুদাম থাকা নতুন নয়। কেন আমরা এটা রোধ করতে পারলাম না?

মাকসুদ হেলালী: রাসায়নিক উপাদান যেভাবে মজুত থাকার কথা, সেভাবে করা হয়নি। যেভাবে নিরাপত্তা রক্ষাকবচগুলো রাখার কথা, তার একটিও করা হয়নি। সরেজমিনে পরিদর্শন করতে দুর্ঘটনার পরে আমি অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। কিন্তু যাওয়া হয়নি। তবে বুঝতে কষ্ট হয় না, রাসায়নিক স্টোরেজের নিরাপত্তা একেবারেই রক্ষা করা হয়নি।

প্রথম আলো: বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা যে সুশাসন ও আইনের শাসনের ঘাটতি দেখি, সেটাই মূল কারণ নয় কি?

মাকসুদ হেলালী: আইনের প্রয়োগ নেই। মানুষের সচেতনতা বোধেরও অভাব আছে। আমাদের মানুষের নিরাপত্তাবোধ যেন একেবারেই উবে গেছে। আমরা সব সময় নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি। কিন্তু আমাদের আশপাশের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করি না। এটাই আমাদের দুঃখজনক চরিত্র।

প্রথম আলো: সূত্রপাত যেভাবেই হোক, আগুন ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এক বা একাধিক ভবনে থাকা রাসায়নিক মজুতকেই বেশি দায়ী করা হচ্ছে।

মাকসুদ হেলালী: এটা রাজউকের দেখার দায়িত্ব। মানুষের বসবাসের ঘর ও রাসায়নিক দ্রব্যের মজুতের স্থান পাশাপাশি রাখার নিয়ম নেই। এটা দেখার কেউ নেই।

প্রথম আলো: আপনার মতে তাহলে ব্যর্থতার জন্য কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা চলে। কেউ তো দায়িত্ব নেয় না।

মাকসুদ হেলালী: রাজউক ছাড়া আরেকটি প্রতিষ্ঠান—কেমিক্যাল মালিকদের সমিতি। আইনকানুনের বাস্তবায়ন উদ্যোগ তারাই প্রতিনিয়ত প্রতিহত করে যাচ্ছে। কারখানা ও স্থাপনা অধিদপ্তর, ইংরেজিতে সংক্ষেপে যাকে বলা হয় ডাইফি, তাদেরও নিয়মিত পরিদর্শনের কথা। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে বিস্ফোরক অধিদপ্তর। তাদেরও দেখার কথা ছিল। বলা হচ্ছে এক্সপ্লোশন ঘটেছে। একটি সিলিন্ডার গ্যাস থেকে হয়েছে। সুতরাং এটাও তাদের আওতাধীন বিষয়। এটাই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

প্রথম আলো: এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা পুরান ঢাকাতেই নাকি রাজধানীর অন্যত্রও আছে?

মাকসুদ হেলালী: দেশের অন্যান্য স্থানেও রয়েছে। বহু ক্ষেত্রে সেফটি নেই। বিশেষ করে যারা কেমিক্যাল ব্যবহার করে, টেক্সটাইল রং করে, তাদের প্রায় সবার কাছেই রাসায়নিক উপাদান থাকে। কিন্তু তা নিরাপদ পরিবেশে থাকে না। সেটাই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। যারাই রাসায়নিক বা দাহ্য দ্রব্যাদি ব্যবহার করবে, তাদের তা ইচ্ছামতো স্থানে রেখে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না।

 প্রথম আলো: ফায়ার কোডের যে অংশটি চকবাজারের পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক, সেটা যদি একটু বিস্তারিত বলেন।

মাকসুদ হেলালী: ১৯৯৩ সালে প্রথম ফায়ার কোড লেখা হয়। তারপর ২০০৬ সালে তা সংসদে আইনে পরিণত হয়েছে। হালনাগাদ করার বিষয়টি আমরা ২০১৫ সালে সম্পন্ন করেছি। আমার জানামতে আইন মন্ত্রণালয় পর্যন্ত কাজটি এগিয়েছে। এরপর কোথায় আটকে আছে, সেটা আমি জানি না। সেখানে যেসব ভবনে রাসায়নিক পদার্থ থাকবে, সেখানে কী কী পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা আছে। যেখানে রাসায়নিক দ্রব্য থাকবে, সেখান থেকে অন্যান্য ভবনের দূরত্ব থাকতে হবে সেটাও বলা আছে। এত বড় একটি বিয়োগান্ত ট্র্যাজেডির পরে আমি ফায়ার কোডের একজন লিখিয়ে হিসেবে আশা করব, এটা অনুসরণ করা হোক। দায়িত্বপ্রাপ্তরা যেন রাতদিন খেটে আইনগুলো বাস্তবায়ন করেন। এটা কাগজে-কলমে লিখে রাখার বিষয় নয়। হালনাগাদ যেখানে যেটুকু করা হয়েছে, সেটা সংসদে পাস হয়নি বলে আমাদের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো উদাসীন থাকতে পারে না। প্রচলিত নিয়ম যা আছে তা তো মানতে হবে।

প্রথম আলো: ফায়ার কোড লঙ্ঘনের কী শাস্তি, কতটা কার্যকর?

মাকসুদ হেলালী: অনধিক সাত বছর জেল। তবে কারও শাস্তি হওয়া দূরে থাক, কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে শুনিনি।

প্রথম আলো: একটি দৃষ্টান্তমূলক বিচারকার্য পরিচালনা করা কি সম্ভব?

মাকসুদ হেলালী: বিচার অবশ্যই সম্ভব। তবে আমি বলব, রাজউকের পক্ষে যিনি ইমারত নির্মাণের অনুমতি দেন, তঁারা চকবাজারের দালানগুলোর অনুমতিপত্র পরীক্ষা করে দেখুন। এটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা যায়। এতে একটি বিষয় বেরিয়ে আসবে। তাঁরা অনুমোদনে একটা ফাঁক রাখেন। তঁারা লিখেন, কতগুলো শর্তে ইমারত নির্মাণেরও অনুমতি দেওয়া হলো। বসবাসের অনুমোদন কেউ নেয় না। কিন্তু শর্ত মানা হলো কী হলো না, সেই ফলোআপ তারা করে না। ঢাকায় সাত লাখের বেশি দালান রয়েছে। প্রায় অধিকাংশ ভবনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে। ৬৭ জনের প্রাণহানির পর অন্তত আমরা দেখতে পারি যে এই শর্তটি পূরণ হয়েছিল কি না।

প্রথম আলো: সম্প্রতি রাজধানীতে আপনারা একটা বড় ভবন পরিদর্শন করেছেন। সেখানে আপনারা কী দেখতে পেয়েছেন?

মাকসুদ হেলালী: আমি এ বিষয়ে কিছুই মন্তব্য করতে চাই না। কারণ, সেটি একটি সংবেদনশীল ভবন। শুধু এটুকু বলব, ওই একই ধাঁচের অনুমতি নিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে। সেখানে সম্প্রতি একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ফায়ার কোডের শর্ত পূরণ করা হয়নি। সম্প্রতি একটি সরকারি কমিটি থেকে আমি ভিন্নমতের কারণে সরে এসেছি।

প্রথম আলো: চকবাজারের ট্র্যাজেডির পরিপ্রেক্ষিতে এই মুহূর্তে কী করা উচিত বলে মনে করেন?

মাকসুদ হেলালী: যেটা বারবার জোর দিয়ে বলতে চাই সেটা হচ্ছে, যাঁরা ইমারত নির্মাণের অনুমতি দেন, তঁারা যেন ড্রয়িং সই করে স্পষ্টভাবে একটি কথা বলে দেন যে এটি অনুমোদিত। যঁাদের দায়িত্বে বসানো হয়েছে, জনগণের টাকায় তাঁরা বেতন নিচ্ছেন। কিন্তু দায়িত্ব নিচ্ছেন না। যিনি দায়িত্ব নিতে পারবেন না, তাঁদের চাকরি করার দরকার কী।