জাতীয় রাসায়নিক সমন্বয় কমিটি দেখতে চাই

>
সুলতানা রাজিয়া
সুলতানা রাজিয়া

ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তিনি নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক ‘অর্গানাইজেশন ফর দা প্রহিবিশন অব কেমিক্যাল উইপেন্স’-এর উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য। চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের পর কী করা উচিত—এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোর মুখোমুখি হন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: রাসায়নিক দ্রব্যের নিরাপত্তায় বাংলাদেশের কী করা উচিত?
সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া: বাংলাদেশ রাসায়নিক দ্রব্যের এক বড় বাজার। আমাদের বার্ষিক আমদানির সাড়ে ৭ ভাগ ধরলে আমরা বছরে ১৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার রাসায়নিক উপকরণ আমদানি করি। এটা আরও বাড়বে। সে জন্য আমাদের একটা নিরাপদ রাসায়নিক অবকাঠামোর দরকার হবে, যেটা এখন আমাদের নেই বললেই চলে। ব্যবসার ছাড়পত্র দেওয়ার মুহূর্তেই কোথায় মজুত ও কী প্রক্রিয়ায় ব্যবহার হবে, তা নিশ্চিত হতে হবে। কিন্তু এখন আমরা তা জানতেই চাই না। রাসায়নিক জীবনচক্র ব্যবস্থাপনা বলে বিশ্বে একটা কথা প্রতিষ্ঠিত। আমাদেরও এটা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু রাসায়নিক জীবনচক্রের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। পোশাক খাতের দিকে বেশি নজর দিয়ে দুর্ঘটনা কমাতে পেরেছি, এখানেও পারব। রাসায়নিক নিরাপত্তার দিকটি অনেকটাই অবহেলিত। তাই দুর্ঘটনা বাড়ছে।
প্রথম আলো: পুরান ঢাকা নিয়ে কী করা উচিত?
সুলতানা রাজিয়া: সেখানে রাসায়নিক নিরাপত্তা বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আবাসিক এলাকায় কোনো রাসায়নিক দ্রব্য থাকতে পারবে না। ব্যবসায়ীদের সামনে নিরাপদ বিকল্প না থাকায় তারা অনিরাপদ অবস্থায় ব্যবসা করছে। তাদের সামনে এখনই ভালো বিকল্প দিন। তারা তা ঠেলে দেবে না।
প্রথম আলো: নিমতলী ঘটনার পর আপনি গুদাম সরানোর কমিটিতে ছিলেন। কী হলো সেখানে?
সুলতানা রাজিয়া: দুটি বৈঠকের পরে আর কোনো সভা ডাকা হয়নি। কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ডাইফি ডেনমার্কের সহায়তায় একটি ‘সেফটি অডিট চেকলিস্ট’ তৈরি করছে। এটা শুধু কর্মীদের রাসায়নিক নিরাপত্তায় নজর দিয়েছে। এটি সব ধরনের রাসায়নিক শিল্পকারখানায় প্রযোজ্য করতে হলে এতে সমস্ত রাসায়নিক প্রক্রিয়ার নিরাপত্তার (প্রসেস সেফটি) বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমরা এ বিষয়ে আমাদের মতামত দিয়েছি। ব্যবসায়ীদের জন্য প্রস্তাবিত ওয়ান উইন্ডো সার্ভিস দ্রুত চালু হওয়া কাম্য।
প্রথম আলো: রাসায়নিক দ্রব্য-বিষয়ক ২০০৯ সালের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে পক্ষ হচ্ছে না কেন বাংলাদেশ?
সুলতানা রাজিয়া: রাসায়নিক দ্রব্যের ‘গ্লোবালি হারমোনাইজড সিস্টেম’কে সংক্ষেপে বলা হয় (জিএইচএস)। সব ধরনের রাসায়নিকের শ্রেণিকরণ, লেবেল লাগানো এবং মোড়কজাতকরণ-সংক্রান্ত এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। বাংলাদেশের উচিত এতে পক্ষভুক্ত হওয়া। বাংলাদেশ যদি এতে পক্ষ হয়, তাহলে তাকে আরও একটি কাজ একত্রে করতে হবে। সেটি হলো ‘সেফটি ডেটা শিট-এসডিএস’ তৈরি করা। কিন্তু এটা তৈরির কোনো প্রক্রিয়া চলমান আছে কি না, আমার জানা নেই।
প্রথম আলো: এই বিষয়ে আপনারা কি সরকারের কাছে কখনো সুপারিশ রেখেছেন?
সুলতানা রাজিয়া: যথাযথ ফোরাম না পেলে তো আমরা তুলতে পারি না। একটা ফোরাম আছে যেমন বাংলাদেশ ন্যাশনাল অথোরিটি ফর কেমিক্যাল উইপনস কনভেনশন। এটা সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের অধীনে কাজ করছে।
প্রথম আলো: আপনি সেখানে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। কী অভিজ্ঞতা?
সুলতানা রাজিয়া: তাদের কাজের জায়গা সীমিত। কেমিক্যাল উইপনস কনভেনশনের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো নিয়েই শুধু তারা কথা বলতে পারে। তবে এ জন্য তারা অংশীজনদের সম্পৃক্ত করছে। যেমন ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার ফর ডিজাস্টার’। দেশে রাসায়নিক বিপর্যয় হলে তাৎক্ষণিক কী আদেশ হবে, সেটা কিন্তু তারা ঠিক করেছে। এ জন্য তারা এটা দেখতে আগ্রহী যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে রসায়ন এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস-সংক্রান্ত পড়াশোনার সময় ছাত্ররা যেন রাসায়নিক নিরাপত্তা নিয়েও একটা ক্রেডিট (১৪ ঘণ্টা) পড়েন। তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাঁরা দেখছেন শুল্ক বিভাগের লোকেরা রাসায়নিক পরীক্ষায় সব সময় ততটা সামর্থ্য রাখছেন না। সার্বিকভাবে আমাদের এ ধরনের বিষয়ে লোকবল ও সামর্থ্য দুটোই দুর্বল।
প্রথম আলো: ১০ লাখ ইউরো ব্যয়সাপেক্ষ যে সুইস প্রকল্পটি চলমান, সেখানে অগ্রগতি কী?
সুলতানা রাজিয়া: ‘টেক্সটাইল কেমিক্যাল ম্যানেজমেন্ট ও সেফটি’ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা কেমিক্যাল অডিট লিস্ট তৈরি করে দিচ্ছি। এটা আমরা অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবহার-উপযোগী করে নিতে পারব।
প্রথম আলো: আপনার বিভাগের ছাত্ররা সম্প্রতি হাটখোলা রোডে গিয়েছিল?
সুলতানা রাজিয়া: সেখানে গিয়ে তারা অনেক রাসায়নিক বোতলে বা ড্রামে যথার্থ লেবেল দেখতে পায়নি। এমনকি তারা অবাক হয় যে অনেকেই লেবেলিং বা সেফটি ডেটা শিট কী, তা তারা বোঝে না। আবার আরেকটা সমস্যা হচ্ছে যে তারা নিজেদের উন্মুক্ত করতে চায় না। তথ্য দিতে ভয় পান। আমদানিকারক বা সরবরাহকারীরাও ছাত্রদের সহায়তা করতে নারাজ। তাঁরা বলতে চান না কোথায় তাঁরা মজুত করেন।
প্রথম আলো: এনবিআর কি রাসায়নিক তথ্যভান্ডার রাখে?
সুলতানা রাজিয়া: প্রথম কথা হলো, জাতীয় রাসায়নিক তথ্যভান্ডার নেই। এনবিআরের রাসায়নিক তথ্যভান্ডার সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। এ ছাড়া এটা পূর্ণাঙ্গ তথ্যভান্ডার কিনা সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। তবে আমাদের একটা উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার থাকা দরকার।
প্রথম আলো: চকবাজারের দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের প্রচলিত রাসায়নিক আইনকানুনের কোনগুলোর কী অবস্থা, তা জরুরি যাচাই করে দেখা প্রয়োজন?
সুলতানা রাজিয়া: প্রথমে বুঝতে হবে যে প্রকৃত অর্থে আমাদের কোনো ব্যাপকভিত্তিক রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা বলে কিছু নেই। যে আইনগুলো আছে সেগুলো সব আলাদা আলাদা করে বিভিন্ন বিষয় দেখে থাকে। যেমন পরিবেশ, শিল্প, জ্বালানি—নানা দপ্তর নানা বিষয় নানাভাবে দেখে। এভাবে চলতে পারে না।
প্রথম আলো: সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশটি কী, বলবেন?
সুলতানা রাজিয়া: স্ট্র্যাটেজিক অ্যাপ্রোচ টু ইন্টারন্যাশনাল কেমিক্যালস ম্যানেজমেন্ট বা এসএআইসিএমের দিকে আমি নজর দিতে বলব। ২০০৬ সালে দুবাইয়ে বাংলাদেশ এটা সই করেছিল। কিন্তু পরে তারা আর কোনো ফলোআপ করেনি। এটা কিন্তু বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক নিরাপত্তার ধারণাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই এই রূপরেখা চুক্তিতে সই করতে সদস্যদেশগুলো রাজি হয়েছিল। বাংলাদেশকে এখন এটা এগিয়ে নিতে হবে। রাসায়নিক দ্রব্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল রয়েছে। আমরা সেই তহবিলের সহায়তায় একটি জাতীয় রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারি। কারও মনে হতে পারে এটা দূরের বিষয়। কিন্তু তা নয়। আমাদের রাসায়নিক নিরাপত্তাব্যবস্থা বিশ্বমানের গড়তে হবে। সে জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে একটি জাতীয় রাসায়নিক কমিটি গঠনের আমি সুপারিশ করি। আমাদের ইতিহাসে অন্য বহু ক্ষেত্রে এ ধরনের কমিটি বা অবকাঠামো রয়েছে। কিন্তু রাসায়নিক নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিতে এ ধরনের একটি উদ্যোগ অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।
রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি আলাদা নিবেদিতপ্রাণ বিভাগ থাকা দরকার। তারা রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা দেখবে। কিন্তু তারা একই সঙ্গে সরকারের অন্য সব অংশ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে। এত দিন যা চলে আসছে, তা খণ্ডিত বা আংশিকভাবে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, এতে কাজ দেবে না। আমরা আনন্দিত যে আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ভালো অবস্থায় রয়েছে। এটা আরও জোরালো হবে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় রাসায়নিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। প্রসেস সেফটি কথাটি আমাদের দেশের মানুষের জানা নেই। এটা চালু করতে হবে। এটা শুধু রাসায়নিক মহাবিপর্যয় রোধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথচ এ বিষয়ে আমাদের কোনো আইন নেই, প্রস্তুতি নেই।
প্রথম আলো: পুরান ঢাকা ও কেরানীগঞ্জে কেমিক্যাল ম্যাপিং?
সুলতানা রাজিয়া: পুরান ঢাকাই নয়, সারা দেশে কোথায় কতটা রাসায়নিক গুদাম বা স্থাপনা আছে, তার একটা জরিপ সেরে ফেলতে হবে। আমি জরুরিভিত্তিতে ইউএনইপির প্রস্তাবনার আলোকে বিশেষজ্ঞ গবেষক, ইন্ডাস্ট্রি এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটি নামে একটি কাঠামো দেখতে চাই যা অদূর ভবিষ্যতে একটি পূর্ণাঙ্গ অধিদপ্তরে রূপ নিতে পারে।