বড় দুর্নীতিবাজেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

পরিসরে দুর্নীতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অধিক মনোযোগ দিচ্ছে। তাদের অধিকতর নজর দিতে হবে যেসব ক্ষেত্রে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সেদিকে। তাদের কার্যক্রমের একটি অগ্রাধিকার তালিকার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হয়েছে।

এসব কথা এসেছে কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাজিরা তদারকি করা নিয়ে। এমনটা করা হয়েছিল কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও। দুদকের বিবেচনায় কাজে হাজির না থেকে বেতন–ভাতা নেওয়া দুর্নীতির নামান্তর। তবে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদ্বয় যথার্থই উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্রের অনেক বড় আর্থিক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে—এমন বিষয়াদি দুদকের কাছে উপেক্ষিত থাকছে। ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয় নিয়মিত। সেসব খাতের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা দুদককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে। তাঁদের মতে, ছোট দুর্নীতির আগে বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। তাহলেই দুর্নীতি দমন অভিযান কার্যকর ও সফল হবে।

ব্যাংক খাত নিয়ে নিয়ত আলোচনা হয়। ঋণখেলাপি হওয়াকে দুর্নীতির সংজ্ঞায় হয়তো ফেলা যাবে না। তবে ভুয়া দলিলপত্র দিয়ে ঋণ নেওয়া অবশ্যই দুর্নীতির আওতায় আসবে। সে ঋণ যাঁরা নিয়েছেন আর দিয়েছেন, সবার অপরাধ শাস্তিযোগ্য। এ ক্ষেত্রে দুদক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। সম্পদের অতি মূল্যায়ন দেখানোও দুর্নীতির মধ্যে পড়ে। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, খেলাপি ঋণের বড় অংশ যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় খুবই কম ও ধীর লয়ে আইনের আওতায় আসছে। ঋণখেলাপিদের বড় অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃপায় এ তালিকা থেকে বাদ পড়ছেন। ব্যাংক খাতে বিপর্যয়ের জন্য তাঁদের ভূমিকা কম নয়। আমাদের শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির অভাব এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি নিয়ে বিদেশেও মামলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সিআইডি এখনো ঘরের তদন্ত শেষ করতে পারেনি। বিষয়টি দুর্নীতি নয় কেন, এটা বোধের অগম্য। দুদক নিজ থেকে এ বিষয়ে এগিয়ে এলে কি তা বেআইনি কাজ হবে? মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। রিজার্ভ চুরির পর তাঁর নেতৃত্বে গঠিত কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, তা আজও প্রকাশ করা হয়নি। অথচ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে বলে সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। প্রকাশ করলে কী ক্ষতি হবে, এটাও বোধগম্য নয়। বিষয়টি জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তার দায়দায়িত্ব চিহ্নিত হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুদকের কোনো অনুসন্ধান, তদন্ত বা অভিযোগপত্র দিতে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয় না। এ আইনি সুযোগের সদ্ব্যবহার আমরা চাই। নতুনভাবে সরকার গঠনের পর সরকারপ্রধান দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। তাহলে তো রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছেই। সে ক্ষেত্রে দুদকের অগ্রগামী ভূমিকায় না যাওয়ার কোনো বোধগম্য কারণ নেই।

ছোট দুর্নীতি আর বড় দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা হয়। তবে এটাও দেখা যায়, ছোট পদে কাজ করা লোকও বিশাল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন। কয়েক দিন আগেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি দপ্তরে নিচের দিকের পদে কাজ করা এক যুগলের সম্পদের বিবরণ জেনে আমরা স্তম্ভিত। তবে এগুলো প্রকৃতপক্ষে নিষ্পত্তি হতে যে সময় যায়, তাতে মূল চেতনা লুপ্ত হয়। বিলম্বিত বিচার বিচার না করার নামান্তর বলে যে কথা আছে, তারই ছাপ আমাদের আইনিব্যবস্থায়। অনুসন্ধানের পর তদন্ত ও চার্জশিট দিতে এত সময় লাগে কেন, এটা দুর্বোধ্য। আর আদালতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দুদক আইনজীবীদের যথেষ্ট তদারকি ও দায়বদ্ধতার মধ্যে রাখতে পারে। ২০১৭ সালে একজন পুলিশ সুপারের আয়ের সঙ্গে সংগতিহীন ও আয়করের সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ না থাকা ১০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যাংকে পাওয়া যায়। অনুসন্ধান দ্রুত হয়। হয় মামলা। অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে মুক্ত আছেন। তবে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে অতি সম্প্রতি, ২০১৯ সালে। এখনো চার্জশিট দেওয়া হয়নি। এই দীর্ঘ সময় লাগার আবশ্যকতা বোধগম্য নয়। এ–জাতীয় মামলা অনুসন্ধানের পর তদন্তে এত সময় লাগার কোনো কারণ নেই। এখানে ব্যাংকের বিবরণী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর নথির নকল এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দাখিলকৃত হিসাব ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যই অভিযোগ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। এসব তথ্য সংগ্রহের জন্য তেমন সময় নেওয়ার কথা নয়। এরূপ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা সম্পর্কে দুদক গণমাধ্যমকে অবগত করতে পারে। ব্যাখ্যা করতে পারে এ বিলম্বের কারণ। তাদের জনবল বা অন্য কোনো সংকট থাকতে পারে। সে সংকট উত্তরণের জন্য সচেষ্ট হলেই তারা সফল হবে।

এটা সত্যি, আইনে ছোট–বড় দুর্নীতির মধ্যে কোনো ফারাক নেই। তবে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে এর প্রভাবের পরিসরে অনেক ব্যবধান। ভূমি অফিসের একজন ছোট কর্মচারী দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার হলে সমাজে যে আলোড়ন হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি আলোড়ন হবে একজন পদস্থ কর্মকর্তা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাটা হলে। এ জন্যই দুদকের নজর থাকতে হবে ওপরের দিকে। প্রশাসনিক কারণেও বিষয়টি যৌক্তিক। দুদকের জনবলকে অনেক ছোট কাজে নিয়োজিত রাখলে ছোট–বড় সব কাজের গতিতে ভাটা পড়তে বাধ্য। সেটাই ঘটছে বলে মনে হয়। দুদকের আইনি কাঠামো অনেক শক্তিশালী। আদালত ছাড়া দুদকের কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারও নেই। দুদকের শক্তিশালী আইনি ও সাংগঠনিক কাঠামোটি থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে তাদের তেমন সাফল্য দেখি না। ভারতের সিবিআই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি সংস্থা। কিন্তু এর সাংগঠনিক ভিত এত শক্তিশালী যে এ প্রতিষ্ঠানের নামে আমলা, রাজনীতিক থেকে বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতির বুক কাঁপে। এ সংস্থা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের কারাবাস নিশ্চিত করেছে। ইতি টানতে হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের। এই সেদিন কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে একটি অভিযোগ তদন্তের জন্য সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভিন্ন রাজ্যে নিয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিবিআইয়ের এই কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে পিছু হটেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা দোষী কি না, তা তদন্ত বা বিচারে পরিষ্কার হবে। তবে তদন্ত সংস্থার এ ধরনের দৃঢ় পদক্ষেপে দুর্নীতিবাজদের টনক নড়ার কথা। আমাদের দুদক কি এমন কোনো দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পেরেছে?

অবশ্য দুদকের নেতৃত্ব আগের চেয়ে কিছুটা সক্রিয় হয়েছে, কিন্তু তার আর বিকাশ ঘটছে না। মনে হয়, কোথাও একটা বিঘ্ন ঘটে গেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যে দুর্নীতির ধারণার সূচক দেয়, তাতে এ বছরে আমরা কিছুটা পেছনে গেছি। আর্থিক ও ব্যাংক খাতে যে অনাচারের চিত্র প্রতিনিয়ত সামনে আসে, শুধু সেটি বিবেচনাতেই ধারণাটিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। প্রতিবেদনটি একটি বার্তা মাত্র। তাই বাহককে দোষ না দিয়ে বার্তাটির দিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কিছু লোককে আইনের আওতায় আনার দাবি দীর্ঘদিনের। এখন আদালতের নির্দেশও এল। এ নির্দেশ অনেকটা পর্যবেক্ষণের মতো হলেও এর নৈতিক শক্তি প্রবল। তা ছাড়া আছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]