নিরাপত্তার 'আরামে দাঁড়াও' ভঙ্গি

বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোথায় ঘাটতি আছে, তা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খোঁজাই জরুরি
বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোথায় ঘাটতি আছে, তা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খোঁজাই জরুরি

বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর বক্তব্য আমাদের এক বড় ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সোমবার ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি দাবি করেছেন, বিমানবন্দরের যে তল্লাশি ব্যবস্থা, তাতে অস্ত্র নিয়ে উড়োজাহাজে যাওয়া সম্ভব নয়। উড়োজাহাজ ছিনতাইচেষ্টায় পলাশ আহমেদ নামের যে যুবক শনাক্ত ও কমান্ডো হামলায় নিহত হয়েছেন, তাঁর তল্লাশি যথাযথ হয়েছে কি না, তা–ও তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন। ‘সিসি ক্যামেরার রিপোর্টটি আমরা দেখেছি। আর দশজন যাত্রীকে যেভাবে তল্লাশি (স্ক্যান) করা হয়, স্ক্রিনিং হয়, সেভাবেই হয়েছে। তাঁর ঘাড়ে ব্যাগ ছিল, সেটি স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়ে গেছে। কোনো কিছু ধরা পড়েনি।’

বিমানবন্দরে স্ক্যানিং মেশিন ছাড়াও সিসি ক্যামেরা ও গোয়েন্দা নজরদারি থাকে। সেখানে অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়ার কথা, তা–ও হয়নি। পলাশ আহমেদ তাহলে অস্ত্র নিয়ে উড়োজাহাজে উঠলেন কীভাবে? তবে আদৌ তাঁর কাছে ‘অস্ত্র’ ছিল কি না, তা নিয়েও আমরা রহস্যের মধ্যে আছি। ‘অস্ত্র’ না ‘অস্ত্রসদৃশ’ কিছু পলাশের কাছে ছিল, কেউই তা খোলাসা করছে না। চট্টগ্রামে কমান্ডো অভিযান শেষে সংবাদ সম্মেলনে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমানের মুখে আমরা অভিযানের সময়ে পলাশের সঙ্গে গুলি বিনিময়ের কথা শুনেছি। আবার পুলিশ বলেছে ‘খেলনা’ পিস্তলের কথা। শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে যে মামলা হয়েছে, তাতে ‘দুষ্কৃতকারীর হাতে বোমা ও অস্ত্রসদৃশ’ বস্তুর কথা বলা হয়েছে। এসব বিভ্রান্তি কাটবে কবে?

বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ভঙ্গ বা নানা ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা যেকোনো দেশেই ঘটতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা ঘটেও। কিন্তু এমন কিছু ঘটলে সভ্য দুনিয়ার রেওয়াজ হচ্ছে, সরকারের তরফে ঘটনার নিয়মিত ব্রিফিং এবং ঘটনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সংবেদনশীল বিশেষ কোনো তথ্য ছাড়া বাকি বিষয়গুলো জনগণের সামনে তুলে ধরা। সেখানে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা এমন কোনো ‘সরকারের মুখপাত্র’ পাই না। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বশীলদের মুখে আমরা নানা বক্তব্য শুনতে থাকি, কিন্তু কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাই না। আরও হতাশার বিষয় হচ্ছে, এসব বক্তব্যের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই কোনো মিল থাকে না। উড়োজাহাজ ছিনতাইচেষ্টা নিয়ে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রেস ব্রিফিং, সংবাদ সম্মেলন ও গণমাধ্যমে দেওয়া দায়িত্বশীলদের বক্তব্য থেকে আমরা যা শুনেছি, তা আমাদের বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে। এসব বক্তব্যের মধ্যে কোনো মিল নেই, বরং পরস্পরবিরোধী। এ ধরনের ক্ষেত্রে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে প্রতিটি কর্তৃপক্ষ নিজেদের কৃতিত্ব নিতে অথবা নিজেদের যে কোনো দায় নেই, তা প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বাস্তবতা হচ্ছে, একজন দুষ্কৃতকারী উড়োজাহাজ ছিনতাই অথবা এ ধরনের বড় কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে অস্ত্র বা অস্ত্রসদৃশ কিছু নিয়ে উড়োজাহাজে উঠেছে। এ নিয়ে সন্দেহ বা সংশয়ের কোনো কারণ নেই যে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোথাও না কোথাও বড় ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। যদি বিমান প্রতিমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী স্ক্যানিং মেশিনের মধ্য দিয়ে এ ধরনের কিছু না গিয়ে থাকে তবে অন্য কোনো উপায়ে বা পথ দিয়ে পলাশের কাছে তা গিয়েছে। এই পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক, কারণ এটা প্রমাণ করে এসব নিরাপত্তা বাধা এড়িয়ে যেকোনো কিছু নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশে সুযোগ ও পরিস্থিতি রয়েছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা নানা সংস্থার কোনো না কোনোটির দায়িত্বে অবহেলা বা গাফিলতির জন্য এমনটি হয়েছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে, কিন্তু অতীতের নানা অভিজ্ঞতার কারণে আমাদের এ সংশয় ও সন্দেহ কাটছে না যে আদৌ তা জানা যাবে কি না? অথবা দায়িত্বে অবহেলা বা গাফিলতির জন্য কেউ শাস্তি পাবে কি না।

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যাঁরা যাতায়াত করেন তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করবেন যে আনুষ্ঠানিকভাবে বা দৃশ্যত নিরাপত্তাব্যবস্থার পর্যায়গুলো কার্যকর রয়েছে। আবার পুরো পরিস্থিতির দিকে খেয়াল করলে অনেক ঢিলে-ঢালা বিষয়ও চোখে পড়বে, যা মানসম্মত কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আপনি দেখবেন না। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে একটি টেলিকম কোম্পানির একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি নিয়মিত ঢাকা থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন। তার অভিজ্ঞতা হচ্ছে; বিমানবন্দরে প্রবেশের পর থেকে উড়োজাহাজে ওঠার আগ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই নিরাপত্তা কার্যক্রমে পেশাদারত্বের অভাব আছে এবং অনেক সময় দেখা যায় পদস্থ বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যাত্রী নন, এমন ব্যক্তিরাও বোর্ডিং লাউঞ্জ পর্যন্ত চলে যাচ্ছেন।

ছোটবেলায় স্কুলে পিটি করার সময় ‘স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ’ ও ‘অ্যাটেনশন’ (আরামে দাঁড়াও ও সোজা হও)-এই দুটি ভঙ্গিতে দাঁড়াতে হতো। বিমানবন্দর বা এ ধরনের সংবেদনশীল স্থাপনায় যাঁরা কাজ করেন, বিশেষ করে নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা থাকেন, তাঁদের সব সময় ওই ‘অ্যাটেনশন’ ভঙ্গিতে থাকার কথা। বিশ্বের অনেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমরা তেমনটিই দেখি। কিন্তু আমাদের দেশের বিমানবন্দরে আপনি সবার মধ্যে কেমন যেন একটা ‘আরামে দাঁড়াও’ ভঙ্গি লক্ষ করবেন। এমন একটি ভঙ্গি নিয়ে আর যাই হোক বিমানবন্দরের মতো সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার পথে যে বিমানটি ছিনতাইচেষ্টার শিকার হয়েছিল, সেখানে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী ছিল। মানে যাঁরা শুধু ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন। এই যাত্রীরা অভ্যন্তরীণ রুটের টার্মিনাল দিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকেছেন। আমরা আমাদের যাতায়াতের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের নিরাপত্তাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক টার্মিনালের তুলনায় আরও ঢিলেঢালা। দুই টার্মিনালের নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলে একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে প্রবেশ করা যাত্রীদের ঢুকতে দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক? বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা বা যেসব সংস্থা রয়েছে, তাঁরা কি কখনো বিষয়টি বিবেচনা করে দেখেছেন?

বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ যেখানে একটি বৈশ্বিক সমস্যা, সব দেশকেই যেহেতু এর বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, সেখানে আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ সব ধরনের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ইস্যুই এখন সমান গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন হামলার ঘটনা ঘটেছিল অভ্যন্তরীণ রুটের উড়োজাহাজ ছিনতাই ও সেই উড়োজাহাজ ব্যবহার করে। সন্ত্রাসীরা যেখানেই ফাঁকফোকর পাবে, সেই পথেই ঢুকে পড়তে চাইবে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তাই এখন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ—এভাবে দেখার সুযোগ নেই।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিমানের উড়োজাহাজ ছিনতাইচেষ্টা ও এর ভাষ্য নিয়ে এক জটিল সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ। অস্ত্র নিয়ে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে একজন যাত্রী উড়োজাহাজে উঠে পড়েছে—এই ভাষ্য আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। আমাদের মনে আছে, নিরাপত্তাব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই বছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি কোনো কার্গো ফ্লাইট যেতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়াও একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা ওঠাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। এই উড়োজাহাজ ছিনতাইচেষ্টা আমাদের জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনতে পারে। আবার যদি ভাষ্যটি এমন হয় যে, যিনি উড়োজাহাজটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিলেন, তিনি আদৌ কোনো মারাত্মক অস্ত্র বা বিস্ফোরক নিয়ে ওঠেননি, তাহলে কমান্ডো অভিযানে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি জায়েজ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

এমন একটি বাস্তবতায় সত্যের মুখোমুখি হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোথায় ঘাটতি আছে, তা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খোঁজাই দস্তুর। সরকার কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিতে যাচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ও উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর সামনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরার কাজটিই এখন সরকারকে করতে হবে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় যে ‘আরামে দাঁড়াও’ ভঙ্গির কোনো সুযোগ নেই, তা মেনে নিয়ে পরিস্থিতি বদলে কাজ করতে হবে।

এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
[email protected]