আইনের শাসনে পিছিয়ে থাকা

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টসের (ডব্লিউজেপি) জরিপমতে, বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশের তালিকার নিচের দিকে থাকা অস্বস্তিকর হলেও ক্ষমতাসীনেরা কঠিন সত্যটি স্বীকার করতে কুণ্ঠিত। তাদের এই অস্বীকৃতি আইনের শাসনকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে। আমাদের পূর্বাপর সরকারের চরিত্র হলো দেশি বা বিদেশি কোনো সংস্থার সূচকে ইতিবাচক কিছু থাকলে সেটি তারা লুফে নেয়; প্রয়োজনে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করে বেড়ায়। আর সূচকে নেতিবাচক কিছু এলে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। আক্ষেপ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও সেই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।

আইনের শাসন, মানবাধিকার কিংবা অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা—প্রায় প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবর নিচের দিকে। ক্ষমতার শীর্ষে আসীন ব্যক্তিরা বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রচার করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে অক্ষম যে কিছু সময়ের জন্য কিছু মানুষকে বোকা বানানো গেলেও সব সময়ের জন্য সব মানুষকে বোকা বানানো যায় না। ডব্লিউজেপির হিসাবে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৩টি দেশের মধ্যে ১০২তম। এর অর্থ ১০১টি দেশ আমাদের ওপরে ছিল। আর নিচে ছিল মাত্র ১১টি দেশ। সংস্থাটির জরিপে চলতি বছরে আরও ১৩টি দেশ যুক্ত হয়ে ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১২তম স্থানে এসেছে। এতে অবস্থানের খুব বেশি হেরফের হয়নি। সূচকের শীর্ষে আছে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড। অন্যদিকে একেবারে নিচে থাকা তিনটি দেশ হলো আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া ও ভেনেজুয়েলা।

উন্নত দেশগুলোর তালিকার কাছাকাছি যাওয়া দূরে থাক, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের চতুর্থ অবস্থান আমাদের আশান্বিত করে না। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অবস্থানও বাংলাদেশের ওপরে। ডব্লিউজেপি যেসব বিষয়কে ভিত্তি হিসেবে সূচক তৈরি করে, তার মধ্যে রয়েছে সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নিয়মিত বাহিনী, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা। আইনের শাসনের জন্য এই অপরিহার্য উপাদানগুলোর প্রতি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা কখনোই খুব বেশি মনোযোগ দেননি। বিরোধী দলে থাকতে যাঁরা আইনের শাসন নিয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, ক্ষমতায় এসে তাঁদের নিস্পৃহতা অত্যন্ত দুঃখজনক। মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তার সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি আমাদের আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে। আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে এসব উঠে না এলেও সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ডব্লিউজেপির জরিপকে পক্ষপাতমূলক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি কিসের ভিত্তিতে এই দাবি করলেন, তা বোধগম্য নয়। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলেও সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে দুটোই মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সে ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা ও নেপালের চেয়ে আইনের শাসনে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে, এ কথা বলা সত্যকে আড়াল করার অপপ্রয়াস মাত্র। অতি সম্প্রতি ভুল আসামি হিসেবে নিরপরাধ জাহালমের তিন বছর জেল খাটা কিংবা প্রতিকার চাইতে গিয়ে নিগৃহীত নারী ও শিশুদের পদে পদে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা আমাদের বিচারব্যবস্থার ভঙ্গুরতার কথাই মনে করিয়ে দেয়।

অতএব, সত্য অস্বীকার না করে প্রতিকারের দিকে মনোযোগী হোন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধাগুলো অপসারণে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিন। সে ক্ষেত্রে আইনের শাসনের সূচকে পেছনের সারিতে থেকে বাংলাদেশকে যেমন নিন্দিত হতে হবে না, তেমনি কোনো আন্তর্জাতিক জরিপ বের হওয়ার পর মন্ত্রীকেও প্রতিবাদ করতে হবে না।