সঞ্চয় সপ্তাহে বেসুরো বার্তা

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিল জাতীয় সঞ্চয় সপ্তাহ। উদ্বোধনী দিনে বিভিন্ন স্লোগানসংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে বের করা হয়েছে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। অনুষ্ঠিত হয় একটি আলোচনা সভা। সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিমের হ্যান্ডবিল বিতরণ ও সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চলে। এমনটা চলে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিস এবং পেশাজীবীদের মধ্যে। কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ কার্যক্রমের আওতায় আসে। হয় উঠান বৈঠকও। ব্যক্তি, পরিবার ও জাতীয় জীবনে সঞ্চয়ের আবশ্যকতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এ সপ্তাহের আয়োজন করা হয়। তবে এবার উদ্বোধনী পর্বেই ইঙ্গিত দেওয়া হলো, সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমতে পারে। তবে আশ্বস্ত করা হয় যে কমানো হলেও এটা ব্যাংকের সুদের চেয়ে বেশি থাকবে।

জানা যায়, সুদের হার সমন্বয় ও সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে অনিয়ম খতিয়ে দেখতে সরকারের গঠিত একটি কমিটি কাজ করছে। সভায় বলা হয়, ‘কমিটির সুপারিশে যদি সঞ্চয়পত্রে সুদ হার কিছুটা কমানো হয়, তারপরও সেটা ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে বেশি থাকবে, যাতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা লাভবান হবে।’ বর্তমান সুদের হার কমিয়ে দিলে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা কীভাবে লাভবান হবেন, এটা বোধগম্য হচ্ছে না। আর ব্যাংকের সুদের হার কত, এটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। বেশ কিছুদিন আগে বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে সরকার থেকে কয়েকটি সুবিধা নেয়। কমানো হয়েছে তাদের করপোরেট করের হার। সরকারি আমানতের অর্ধেক পরিমাণ সেসব ব্যাংকে রাখার নিয়মও করা হয়েছে। কিন্তু বেশ সময় গেলেও স্বল্পসংখ্যক বেসরকারি ব্যাংকই সীমিত পরিসরে এক অঙ্কের সুদে বিনিয়োগে যাচ্ছে। শিল্প উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকেও এ ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দুই অঙ্কের সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। তাহলে তারা ১৪-১৫ শতাংশের কম সুদে বিনিয়োগ করবে কীভাবে?

অন্যদিকে সরকারি ব্যাংকগুলো মূলত সরকারের নির্দেশ মেনে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। এ ঋণের একটি অংশ যাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকে। সেসব ব্যাংককে ১০ শতাংশের বেশ ওপরের সুদ হারেই বিনিয়োগ করতে হবে। তবে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংকই তিন মাস মেয়াদি স্থায়ী আমানতের সুদ ৬ শতাংশে সীমিত করে ফেলেছে। বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা, এই ৬ শতাংশকেই ভিত্তি ধরে সঞ্চয়পত্রের নতুন সুদের হার নির্ধারিত হবে কি না? সঞ্চয় সপ্তাহের উদ্বোধনী দিনের এ বার্তা আমানতকারীদের কাছে অনেকটা নির্মম ঠেকছে।

এটা সত্যি, শিল্প ও ব্যবসার ব্যয় যত কম হবে, তত প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাজারে ঠাঁই করতে পারে। এর জন্যই নানামুখী প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বলা হয়, ব্যাংক আমানত থেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুদের হারে বড় ধরনের ফারাক থাকায় আমানতকারীরা একতরফাভাবে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন। কথাটা হয়তো অসত্য নয়। তবে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বরাবরই ব্যাংক আমানত থেকে বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও ২০১০ সালের শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের আগ পর্যন্ত ব্যাংকে টাকা ঘাটতির কথা তেমন শোনা যায়নি। উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে বর্তমান হারেই ঋণ পেতেন। সরকারও ঋণ নিত।

আর সঞ্চয়পত্রের আমানত পুরোটাই সরকারের ঋণ। এর জন্য কিছু বেশি পরিমাণ সুদ দিতে হচ্ছে। সেখানে টাকা না থাকলে সরকারকেও ঋণ নিতে হবে ব্যাংক থেকে। তখন অবস্থাটা কী হবে, একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন।

কয়েকটি সঞ্চয়পত্রে (পেনশন সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র) বিনিয়োগ বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমিত। উপকারভোগীরা সাধারণত প্রবীণ, বিধবা নারী। অনেকের আয়ের একমাত্র কিংবা প্রধান উৎস সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। টাকা তুলে অনেকেই ছোটেন ওষুধের দোকান, ক্লিনিক কিংবা মুদিখানায়। সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার প্রায় ২ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বছর তিনেক আগে। তবে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র বড় একটি অংশ ধনিকশ্রেণির হাতে আছে বলে ধারণা করা হয়। সব সঞ্চয়পত্রেরই সর্বোচ্চ ক্রয়সীমা আছে। পেনশন সঞ্চয়পত্র তো পেনশনের কাগজ দেখেই খোলা হয়। সঞ্চয়পত্রগুলো ডিজিটাল ব্যবস্থায় আনার জোর প্রচেষ্টা চলছে। তা আনা হলে সীমার অতিরিক্ত যাঁরা কিনেছেন, তাঁদের সুদ কেটে রাখা, বন্ধ করা, এমনকি বাজেয়াপ্ত করার নিয়মও করা যায়। এ ব্যবস্থা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য সঞ্চয়পত্রগুলোর সুদের হার কমিয়ে দিলে আমানতকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এগুলো বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ব্যবস্থাটা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

সঞ্চয়পত্রের মুনাফার সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত এবং তা পরিশোধ করতে গিয়ে সরকার ফতুর হয়ে যাচ্ছে বলে একটি ধারণা চালু আছে। এর চেয়ে বেশি সুদে যে সরকারের ঋণ আছে, তার কথা কিন্তু তেমনভাবে আলোচিত হয় না। সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের বেতনের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিডেন্ট ফান্ডে রাখতে পারেন। এর সুদ হার ১৩ শতাংশ। এটা নন–ফান্ডেড বটে। তবে যেকোনো বিবেচনায় সরকারের ঋণ। বিষয়টি সরকার রেখেছে তার কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বিবেচনায়। তারা প্রয়োজনে ধার পায়। অবসরের সময় আয়করমুক্ত মুনাফাসহ মোটা টাকা ঘরে আসে। এটা থাকুক। প্রয়োজন আছে। সেইরূপ সামাজিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়েই সরকার এককালীন পুরো পেনশন সমর্পণকারীদের অবসরের ১৫ বছর পর আবার তা চালু করার নিয়ম করেছে। এর কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল না। নেহাত সদিচ্ছা থেকেই বৃদ্ধ লোকগুলোর কিছু আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা হয়েছে।

সরকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। জনজীবনের সব অংশের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে তাদের কাজ করতে হয়। তিন মাস মেয়াদি আমানতে সরকার ব্যাংকের জন্য যে ৬ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা থেকে আগাম আয়কর, লেভি ইত্যাদি কেটে যা পাওয়া যায়, তা মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে কম। এ ঋণ আমানত ব্যবস্থাটিকে সরকার আগের মতো বাজার অর্থনীতির ওপর ছেড়ে দিতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তো আছেই। এভাবে টানাহ্যাঁচড়া করে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাবে কি?

যাঁরা ব্যাংকের মালিকদের দোষ দিচ্ছেন, তাঁদেরও কেউ কেউ কোনো কোনো ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক। সুতরাং একে অপরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংকও বিপন্ন বলে লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রায় লাখো-কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। বড় খেলাপিরা নিয়মনীতির ফাঁকে এ তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন বলে জানা যায়। খেলাপি ঋণ ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। এর মধ্যেও যতটা সম্ভব কম সুদে উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পেতে হবে। সেটা এক অঙ্কে সীমিত না থাকলেও তাঁরা অন্যবিধ সুবিধা পেয়ে যাচ্ছেন। অন্য দেশের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি পাচ্ছেন। খুব কম দামে পাচ্ছেন শ্রমিক। আমরা উদ্যোক্তাদের অধিকতর সমৃদ্ধি চাই। তাঁরা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানসহ বহু ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন।

সঞ্চয়পত্রের সুদের হার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক। তাঁদের আয়কর বিবরণীসহ আয়ের উৎস—সবই খতিয়ে দেখা উচিত। সঞ্চয়পত্রে নির্ভরশীল ব্যক্তিরা আইনকানুনে ভয় করেন। তাই মেনেও চলেন। বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত তাঁরা কর ফাঁকিও দেন না। সম্পদ বিবরণীতেও এগুলো উল্লেখ থাকে। সঠিকভাবে যাচাই করা হলে গলদ বেরিয়ে আসবে ধনিকশ্রেণির লোকদের কেনা সঞ্চয়পত্রে। তাই এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আর্থিক দিকের পাশাপাশি সামাজিক দিককে গুরুত্ব দিতে হবে। গড়ে ওঠা সামাজিক নিরাপত্তা বলয়টিকে দুর্বল করা হলে তা হবে সরকারের চলমান নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জাতীয় সঞ্চয় দিবসের উদ্বোধনী লগ্নে যে বার্তাটি এল, তা ধনিকশ্রেণির সঞ্চয়পত্রের জন্যই প্রযোজ্য হোক।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]