আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনার সুফল

তিন যুগের বেশি সময় ধরে শিশুশিক্ষা ও শিশুর বিকাশ নিয়ে কাজ করছি। শুরুটা করেছিলাম ১৯৭৫ সালে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শিশুদের নিয়ে সৃজনশীল নানা আয়োজনের মাধ্যমে। ছবি আঁকা, গল্প শোনা ও বলা, গান করা, নাটক মঞ্চায়ন, নিজেরা এটা–ওটা বানানো, নানা জায়গায় বেড়ানো—এমনই সব আয়োজন থাকত। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ষাটের দশকের একটি স্লোগান—এ শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টাতে হবে। আমরা বলতাম এটা ঔপনিবেশিক পদ্ধতির কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা, এটা স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষা নয়। তখন কেউ ভাবেনি চলমান ব্যবস্থা পাল্টে বিকল্প সঠিক পদ্ধতি কোনটি, এর নমুনাই–বা কে তৈরি করবে। সেই ভাবনা থেকে ১৯৮১ সালে ফুলকিতে আমরা চালু করি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহজপাঠ। শুরু করেছিলাম ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। ৩৮ বছর পরে এখন এ সংখ্যা ৮০০-এর কাছাকাছি।

আমরা সচেতন ছিলাম যে আমাদের সমাজ শিক্ষকের একটা ভীতিকর ভাবমূর্তি লালন করেছে, শিশুর জেদ ও অবাধ্যতার শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অংশ হলো এই ভাবমূর্তির ব্যবহার। তাই প্রথম কাজ হলো এই নেতিবাচক খোলস থেকে শিক্ষক ও স্কুলকে বাইরে রাখা। আমরা স্কুল সম্পর্কে দুটি কথা বললাম—শিশুরা স্কুলে আসবে নির্ভয়ে এবং সময়টা কাটাবে আনন্দে। আমাদের লক্ষ্য ছিল আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা। ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশে স্কুলগুলো বন্দিশালার মতো—উঁচু প্রাচীর, বন্ধ গেট, গম্ভীর ও রাগী শিক্ষক, রুটিনবদ্ধ কক্ষবন্দী জীবন এবং সর্বোপরি পরীক্ষা ও ভালো নম্বরের অনিবার্য শৃঙ্খল। আরও মনে করেছি ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এবং স্কুলের সময়কাল গোড়াতেই ঠিক করতে হবে, যাতে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের কার্যকর সংযোগ বাড়ানো যায়। আর অবশ্যই হাসিখুশি ইতিবাচক তরুণ-তরুণীদের ওপরই নির্ভর করেছি।

আমাদের জায়গাটা ছিল ছোট। কিন্তু আমরা জানতাম সেটা মূল সমস্যা নয়। আমরা শিশুদের মনোজগতের পরিসর বাড়ানোর জন্য নানা কাজে অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়েছিলাম। আমরা লক্ষ করেছি চার, পাঁচ, ছয় বছর বয়সে শিশুর জন্য যেটুকু পাঠ বরাদ্দ থাকে, তা আয়ত্ত করতে শিশুর বেশি সময় লাগে না—যদি তাদের মন থাকে আনন্দে। এ রকম পরিবেশ তাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করে, তাদের গ্রহণ করার ইচ্ছাও পুষ্টি পায়। আর তা ছাড়া প্রথম তো তাদের ইন্দ্রিয়গুলোর এবং আঙুল ও কবজাসহ অঙ্গগুলোর স্বাভাবিক বিকাশ ও দক্ষতার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। আদতে প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠনের চেয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতিতেই জোর দেওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘শৈশব হলো সংগ্রহ ও সঞ্চয় করিবার বয়স।’ অর্থাৎ এটা ফল দেওয়ার সময় নয়। তাই প্রথম থেকেই আমরা প্রাথমিকে পরীক্ষা না রাখার পক্ষে বলতে শুরু করি। তবে বাস্তবে অভিভাবকেরা এতটা ব্যতিক্রমী চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে তৈরি ছিলেন না, তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের তো হাইস্কুলে যেতে হবে এবং সব স্কুলই তো পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাতেই অভ্যস্ত। তাই আমরা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে কিছু পরীক্ষা রাখলাম, কিন্তু তা বিশেষ আয়োজন ছিল না, আর নম্বরের পরিবর্তে গ্রেড দিতে শুরু করি। ১৯৮১-৮২ সালে এসব খুবই ব্যতিক্রমী কাজ গণ্য হতো, মানানো কঠিন ছিল। বিখ্যাত স্কুলের অধ্যক্ষ বলেছেন—তোমাদের এসব নিরীক্ষা চলবে না। কিন্তু আমরা পিছু হটিনি। বলেছি, কারণ নম্বরের চেয়ে গ্রেডেই মূল্যায়ন হয় সঠিক। আমরা বলেছি—ক মানে খুব ভালো, খ ভালো, গ মোটামুটি এবং ঘ আরও ভালো করতে হবে। আরেকটা বিষয় আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শিখলাম। তিনি বলেছেন, কিছু ধারণ করার জন্য যেমন আধারের প্রয়োজন হয়, তেমনি শিক্ষার আধার হলো সংস্কৃতি।

এখানে বলা ভালো হবে, আমরা যারা ফুলকি গড়া ও পরে স্কুল চালানোর কাজে যুক্ত হয়েছি, তাদের বেশির ভাগই ছিলাম ষাট দশকের সংস্কৃতিকর্মী। সাধারণত সংস্কৃতি বলতে আমরা গান-নাচ, আবৃত্তি, অভিনয়, ছবি আঁকা ইত্যাদিকে বুঝিয়েছি। কিন্তু শিশুদের নিয়ে কাজের কিছু অভিজ্ঞতা আর শিক্ষা নিয়ে কিছু পঠনপাঠনের ফলে সংস্কৃতি বলতে কলাচর্চায় মেতে উঠিনি। এ নিয়ে নিজেরা ভেবেছি, আলোচনা করেছি। এখানে পঠনপাঠনের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের একদিকে শিখতে হবে দলে মিলে কাজ করা, অন্যদিকে নিজের মানবিক গুণাবলির বিকাশ সাধন। শিক্ষায় সংস্কৃতিচর্চার এটাই হবে মূল কাজ। কিন্তু যেসব বিষয়ে সবার আগ্রহ সেগুলো মূলত কলা যা সাধারণত ব্যক্তিগত প্রতিভা ও দক্ষতারই প্রকাশ ঘটায়। যদি সচরাচর যেভাবে শেখানো হয়, সেই বাঁধা পথে চলি, তাহলে শিশুর ব্যক্তিগত দক্ষতার ওপর জোর পড়বে এবং তা তাৎক্ষণিক যে প্রশংসা ও স্বীকৃতি এনে দেয়, তাতে শিশুও মজে যাবে। তার আত্মকেন্দ্রিক হওয়া, অহমিকায় ভোগার আশঙ্কা বাড়বে। কলাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে, কিন্তু জোরটা থাকবে যৌথভাবে শেখা, চর্চা, পরিবেশনায়। তবু এর সীমাবদ্ধতা থেকে যায়।

মানবিক গুণাবলি, যেমন ন্যায়বোধ, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, সেবাপরায়ণতা, মমত্ব, মহানুভবতা ইত্যাদি অর্জনে সাহিত্যসহ বিচিত্র বিষয়ে পঠনপাঠন ও অনুশীলনের বিকল্প নেই। দেশপ্রেমও তো নিছক ভাবালুতার বিষয় নয়, দেশকে তার ভূগোল ও ইতিহাসের ভিত্তিতে জানতে হবে, ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপট ও সংস্কৃতির ধারায় বুঝতে হবে। তাই আমরা নানা রকম পঠনপাঠন ও নানা বিষয় চর্চার ওপর জোর দিয়েছি। তাতে সবারই অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হলো। আর রবীন্দ্রনাথেরই সূত্রে প্রকৃতির সান্নিধ্যের কথা মাথায় রেখে বহিরঙ্গন ক্লাসের ব্যবস্থা রেখেছি বরাবর।

অনেক বছরের ব্যবধানে দেখলাম, আমাদের প্রায় সব শিশু সুরে গাইতে পারে, আঁকা-পড়ায় আনন্দ পায়, এগারো হাজার বইয়ের পাঠাগার নিয়মিত ব্যবহৃত হয়, বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় কথা, সব শিশুই প্রাণবন্ত। আর পাবলিক পরীক্ষা পিইসিতে সবচেয়ে দুর্বল শিশুটিও ভালো ফল করতে পারছে। তবে এ বয়সটা যেহেতু ফল দেওয়ার নয়, দীর্ঘকাল ফলপ্রসূ থাকার প্রস্তুতির কাল তাই পরীক্ষাটা বাহুল্য ও অনৈতিক বলে মনে করি।

এভাবে দেখা যাচ্ছে, শিশু আনন্দের সঙ্গে তাদের জন্য নির্ধারিত দক্ষতাগুলো অর্জন করে বাড়তি তোড়জোড়, শাসন, ধমক ছাড়া। এই অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে আমরা অন্যান্য স্কুলেও সিলেবাসভিত্তিক লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতির পাঠের জন্য একটি পাঠক্রমসহ কর্মসূচি তৈরি করেছি। মনীষী কথা, গল্পসল্প, ছড়া-কবিতা, মানবিকতা, অধিকার, বিজ্ঞান বিচিত্রা, কীর্তিকথা এবং গান, চারুকলাসহ এটি একটি প্যাকেজ। ২০০১ সাল থেকে দেশের কয়েকটি জেলার গোটা ত্রিশ স্কুলের হাজার কুড়ি শিক্ষার্থীকে নিয়ে পরিচালিত এ কার্যক্রমের ফলাফল নিয়ে নিরপেক্ষ এক জরিপে দেখা গেছে, এতে স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ে, তাদের আত্মবিশ্বাস ও সাবলীলতা বাড়ে, পড়াশোনা ও চর্চার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।

আমাদের দেশে বইয়ের বোঝা কমানোর কথা খুব শোনা যায়। অভিজ্ঞতা থেকে বলব, পড়াটা তখনই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, যখন শিশুকে ভালো ফলের লক্ষ্য পূরণের জন্য পড়তে হয়। নয়তো পড়তে শেখা, নতুন শিঙের মতোই, ব্যবহারে আনন্দ বাড়ে। পড়ার মধ্যে কেবল জানার আনন্দ নয়, নিজেকে বড় করে তোলার তৃপ্তিও মেলে। শ্রেণিকক্ষে এ কাজটার জন্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর না করে ডিগ্রি ও তার ওপরের পর্যায়ের শিক্ষার্থী-স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভর করা যায়। আসলে সব তরুণই তো দেশের কাজ, মহৎ কাজে শরিক হতে চায়।

প্রাথমিকের শিক্ষার মানের যে হতাশাজনক চিত্র বিশ্বব্যাংক ও সরকারি জরিপে উঠে এসেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। এর জন্য যেমন সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে, তেমনি যেসব কাজ সফল হয়েছে তা–ও বৃহত্তর পরিসরে কাজে লাগানোর কথা ভাবা যায়। পাঁচ কোটি শিশুর মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা একা সরকারের জন্য কঠিন, বিচ্ছিন্ন উদ্যোগেও সম্ভব নয়। এর জন্য সরকার ও সমাজের সমন্বিত ভূমিকার বিকল্প নেই। পাঁচ বছরের বিশেষ অগ্রাধিকার কর্মসূচি নিয়ে বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে এক ধাক্কায় স্কুলশিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব। আমাদের সে পথেই এগোতে হবে।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক