বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য হ্রাস, ব্যক্তি খাতের বিকাশ, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় ব্যক্তি খাতের টিকে থাকা এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা—এগুলোর আলোকে আমরা যখন বাজেট তৈরি করতে যাই, তখন দেখা যায় বাজেট বিশেষজ্ঞ ও প্রণয়নকারীরা এখনো 

যথেষ্ট বিচলিত। বিগত কয়েক বছর আমরা দেখতে পেয়েছি যাঁরা বাজেট প্রণয়ন করছেন, তাঁরা বাজেট তৈরিতে যেন একটি বিষয় সব সময় মাথায় রাখছেন। সেটি হলো আমরা যে বাজেটই করি না কেন, সেটা তো প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেই এবং তিনিই ঠিক করবেন কোনটি রাখবেন, কোনটি রাখবেন না। এই রাখা না-রাখাটা অনেকটা নির্ভর করছে রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর।

এর ফলে আমরা দেখি, বারবার বলার পরেও আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কোথায় কোন ভ্যাট সংযোজিত হবে কি বিয়োজিত হবে, কোথায় কোন ট্যাক্স অন্তর্ভুক্ত হবে প্রভৃতি নিয়ে কোনো জোরালো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই বলছেন, আমাদের নতুন নতুন কর খাত বের করা উচিত। কিন্তু আমরা সেটা পারছি না। এ কারণে বাজেট প্রণয়নকারীরা শেষ মুহূর্তে গিয়ে ঘুরেফিরে পরোক্ষ করের ওপর ভর করেন। এখানে কর খাত বাড়ানো যাচ্ছে না বিধায় যাঁরা বর্তমানে কর প্রদান করছেন, তাঁদের ওপরই ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও ব্যক্তি খাতের বিকাশের ফলে একটি বৃহৎ ভোক্তা সমাজও গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে সাড়ে ৬ হাজার ডলার বা ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকার মতো ব্যয়যোগ্য আয় করে এমন লোকের সংখ্যা প্রায় সোয়া কোটি। তাহলে আমাদের টিআইএন সংখ্যা এত কম কেন? আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পরিমাণ এত নগণ্য কেন? অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন আয়কর রিটার্নের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আমরা কী উদ্যোগ নিয়েছি? আমরা পারছি না কেন? আমরা অনেকবার বলেছি বর্ধিষ্ণু খাতগুলোতে কর ধার্য করা যায় কি না, সেটা দেখার জন্য। গত ২০০৭-০৮ সালে সাধারণ খাতগুলোকে বাইরে রেখে নতুন কোথায় কর ধার্য করা যায়, সে ব্যাপারটা দেখার জন্য একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা খুব একটা এগোয়নি। এমনকি কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য শাস্তির বাস্তব উদাহরণও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমরা কোথায় কর অব্যাহতি দেব ও কেন অব্যাহতি দেব, এগুলো পরিষ্কার করতে পারছি না। আমরা অনেক দিন যাবৎ বলে আসছিলাম যে ভ্যাট যদি বাড়ানো হয় তাহলে যেন আয়কর কিছুটা কমানোর চেষ্টা করা হয়। সামগ্রিকভাবে আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কিন্তু অপরাপর অর্থনীতি বা দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। আমাদের এখানে ব্যাংকের সুদের হার বেশি, করপোরেট ট্যাক্স বেশি, ভ্যাট বেশি, ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রদানকারীদের প্রায়ই হয়রানির শিকার হতে হয়। বিভিন্ন খাতে স্থানীয় ও বিদেশিদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য করা হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হলো অপ্রত্যাশিত কর আরোপ। আমরা জানি না কখন কোথায় করের জালে আটকে যেতে হয়। আমরা রাজস্ব পরিকল্পনা করতে গিয়ে বিপদে পড়ে যাই যে পরের বছর আমাদের কী অবস্থা হবে।

অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে মধ্যবিত্ত। প্রতিটি বাজেটপ্রণেতার উচিত হবে এই মধ্যবিত্তের হাতে একটুখানি বেশি টাকা দেওয়া যায় কি না, সেটা ভাবার। এতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ ছাড়াও অনেকগুলো উন্নয়ন হতে পারে। এই মধ্যবিত্তকে নিয়ে কোনো গবেষণা না থাকার ফলেই বাজেটে তাদের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা আমরা দেখতে পাই না। অনেক সময়ই তারা এর ফলে নিজেদের প্রতারিত মনে করছে। যার কারণে সরকার ভালো কাজ করলেও মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। সুযোগ পেলেই তারা সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠছে।

আমাদের অবশ্যই কর খাতকে সম্প্রসারিত করতে হবে। এর জন্য প্রধান কাজ হওয়া উচিত কর নিয়ে গবেষণা। সর্বোপরি, রাজস্ব গবেষণাকাঠামোকে একটা আইনি কাঠামোতে রূপদান করতে হবে। আমরা ট্যারিফ কমিশনকে খুব একটা কার্যকর দেখতে পাই না। ট্যারিফ কমিশন যদি আরও বেশি গবেষণাধর্মী হতো তাহলে বেঞ্চমার্কিং স্টাডি করার মাধ্যমে কর আরোপের নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধানের পাশাপাশি এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেত।

বাংলাদেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি চাকরিজীবী, টিআইএনধারীদের সংখ্যা ধীরে হলেও বাড়ছে। দেশের খবরের কাগজগুলোও বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। আজ পর্যন্ত কোনো পত্রিকায় দেখিনি যে কর খাত সম্প্রসারণের পক্ষে তারা বলছে না। কিন্তু তারপরও তারা হতাশ কেন? কারণ দেখা যাচ্ছে, যাঁরা নিয়মিত কর প্রদান করেন, তাঁদের কাছ থেকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কর আদায় করা হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখিয়ে কর বাড়ানো হচ্ছে। এটা একপেশে কর্মকাণ্ড। দ্বিতীয়ত, করের যে আইনি ব্যাখ্যা রয়েছে, যেখানে বলা আছে কর ফাঁকি দিলে কী হবে। এ আইনের প্রয়োগ কিন্তু আমরা দেখতে পাই না।

আমরা বারবার বলছি, আমাদের বেসরকারি খাত অর্থনৈতিক বিকাশের হাতিয়ার হবে, সে ক্ষেত্রে করপোরেট কর কমাতে হবে। যাঁরা ভালো কাজ করছেন, নিয়মিত কর দিচ্ছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, তাঁদের সহযোগিতা করতে হবে। বড় বড় কোম্পানিকে আমরা কীভাবে পুঁজিবাজারে আনতে পারি, সেই দিকগুলো নিয়ে ভাবা উচিত। তারা যাতে কর ফাঁকি দিতে কাঁচাবাজারে না যায়, মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়ে না রাখে কিংবা ফরেন কারেন্সির মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাঠিয়ে না দেয়।

আমরা চাই ব্যাংকিং খাত আরও বেশি লাভ করুক যাতে তারা আরও বেশি কর দিতে পারে, আমরা চাই দেশের মধ্যে টেলিকম কোম্পানিগুলো আরও বেশি ক্ষেত্র তৈরি করুক, যাতে তারা আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারে, একই সঙ্গে তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের উদ্যমকে আরও বেশি উৎসাহিত করতে হবে।

আমাদের আইনি সংস্কার প্রয়োজন। মান্ধাতার আমলের আইন নিয়ে নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের সহায়তা করা যাচ্ছে না। শুধু বাজেট বাস্তবায়ন নয়, বাজেট পরিকল্পনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সত্যিকার অর্থে তরুণ, মেধাবী, শিক্ষক, উদ্যোক্তা এবং যাঁরা উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন, তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

সব ধরনের বৈঠকে কেন অর্থমন্ত্রী বা সচিবকেই থাকতে হবে? নতুন বা পরবর্তী বৈঠকটি কেন ১ জুলাই থেকে শুরু হতে পারে না? এই বৈঠক কেন উদ্যোক্তাদের ক্লাব দিয়ে শুরু হতে পারে না? যাঁরা বুয়েট থেকে পাস করলেন, যাঁরা বিদেশে অর্থনীতি পড়াচ্ছেন, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক বা ব্যবসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে একজন সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মিটিং করা শুরু করুন। যে সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অস্ট্রেলিয়া থেকে পাবলিক ফিন্যান্সে মাস্টার্স করে দেশে ফিরলেন, আমরা তাঁকে দেখতে চাই। নেস্‌লে, স্যামসাং, আলিবাবাতে যে বাংলাদেশি তরুণেরা কাজ করছেন, তাঁদের কথা শুনতে হবে।

খবরের কাগজ খুললে আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশি তরুণদের সাফল্যের কথা, গত ২০ বছরে আমেরিকার আইভি লিগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশি ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়েছেন, তাঁরা কোথায়? তাঁদের নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি অনলাইন পোর্টাল খোলা হয় না কেন? অর্থ মন্ত্রণালয়ে একবার একটা অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল খোলার চেষ্টা করেছিলেন মরহুম এস এ এম এস কিবরিয়া। সেটি বছরব্যাপী অর্থ বিভাগের জন্য স্বল্প পরিসরে কাজ করতে থাকবে। এখানে নিযুক্তরা অবৈতনিক হবেন। তাঁরা পরামর্শ দেবেন এবং সরকারের পক্ষে চ্যালেঞ্জও নিতে পারবেন।

আরও একটা বিষয়, বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে এমনকি সম্পূরক বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা কোথায়? এখানে বাজেট আলোচনার নামে ৭০ শতাংশ হচ্ছে সরকার বা ব্যক্তির বন্দনা। এটা কি কোনো বিকাশমান অর্থনীতির পরিচায়ক?

পুরোনো যাঁরা অর্থসচিব রয়েছেন, তাঁরা বলছেন, সংসদে বাজেটকে প্রভাবিত করার খুব বেশি সুযোগও নেই। বাজেট ঘিরে সংসদে তেমন একটা গঠনমূলক আলোচনা দেখছি না আমরা। এটা খুব দুঃখজনক। সংসদে বাজেট নিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। আমরা জানতে চাই আবগারি শুল্ক, করপোরেট কর, দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্যকরণ, তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্যোগকে সাংসদেরা কীভাবে উৎসাহিত করতে চান।

সরকারি ডাক্তার এবং প্রকৌশলীদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হোক। এসব নিয়ে তো কোনো আলোচনা হয় না সংসদে। এমনকি আমাদের বিচার বিভাগও প্রায়ই নিশ্চুপ। যদিও ইদানীং কিছু কিছু ভালো কাজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তবু সামগ্রিক প্রয়াস নিয়ে এগোতে হবে। তা না হলে আমাদের বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের সমস্যা কাটবে না।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক