ইঁদুর মারা বিড়াল চাই

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিজেকে যতই নির্দোষ দাবি করুক না কেন, তাদের নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে। দুদকের মামলায় বিনা অপরাধে পাটকলশ্রমিক জাহালম প্রায় তিন বছর কারাভোগ করে সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন। এই মামলায় দুদক ব্যাংকের ওপর দায় চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। দুদক বলেছে, অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে টাঙ্গাইলের জাহালম প্রকৃত আসামি নন, আসামির নাম সালেক, বাড়ি ঠাকুরগাঁও। গত ২৮ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘৩৩ মামলায় ভুল আসামি জেলে: স্যার আমি জাহালম, সালেক না’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর চারদিকে হইচই পড়ে যায়। একজন আইনজীবী আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। গত বুধবার মামলার শুনানিকালে হাইকোর্ট মামলার সব কাগজপত্র তলব করেছেন।

আদালত এখানে যে প্রশ্নটি তুলেছেন তা হলো, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তদন্তে ভুল আসামির বিষয়টি ধরা পড়ার পরও কেন দুদক নির্বিকার ছিল?
দুদক এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেনি। এখন অভিযোগকারী ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর দায় চাপিয়ে দুদক আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। যদি এখানে ব্যাংক
কর্মকর্তারাই ভুল আসামিকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকেন, তাহলে দুদকের তদন্তকারী দল কী করেছে? যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে কেউ অভিযোগ আনতে পারেন। দুদকের দায়িত্ব সেই অভিযোগের সত্যাসত্য বিচার করা। নিরপরাধ মানুষকে জেলে পাঠানো এবং অপরাধীকে বাঁচানো এ সংস্থার কাজ হতে পারে না।

সরকারি কোনো সংস্থা সঠিক তদন্ত করবে না কিংবা তাদের তদন্ত পক্ষপাতমূলক হবে—এই শঙ্কা থেকেই মানুষ দুদকের শরণাপন্ন হয়, তার কাছে প্রতিকার চায়। প্রতিষ্ঠানটির উচিত নিজের ভুল স্বীকার করে দায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া এবং জাহালমকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া। দুদক নিজেকে স্বাধীন সংস্থা বলে দাবি করলেও তাদের কাজে ও আচরণে সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

যেখানে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপ করেও আসামিরা পার পেয়ে যায়, সেখানে জালিয়াতির অভিযোগে এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেল খাটিয়ে কী উদ্দেশ্য সাধন করল দুদক? আদালত যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘যে বিড়াল ইঁদুর মারতে পারে না, সেই বিড়াল থাকার দরকার কী।’ আদালতের এই ভর্ৎসনার পরও দুদকের কর্মকর্তাদের বোধোদয় হবে কি না, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে।

তবে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে না, দুর্নীতিবাজদের ধরার বিষয়ে তাঁরা আন্তরিক। দুর্নীতি দমন কখনোই পিক অ্যান্ড চুজ বা বাছাই করা পদ্ধতিতে হতে পারে না। দুদক চুনোপুঁটি দুর্নীতিবাজদের পেছনে ছোটে, কিন্তু দুর্নীতির রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। জনমনে এই ধারণাও রয়েছে যে সরকার যাদের ধরতে চায়, দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে, আর যাদের দুর্নীতি ধরতে চায় না, তাদের বিষয়ে নিশ্চুপ থাকাকে শ্রেয় মনে করে।

যখন জাহালমের মামলা নিয়ে ব্যাপক হইচই, তখন এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান টিআইবির জরিপকে একচোখা বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন। এতে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা খুশি হতে পারেন, কিন্তু দুর্নীতির লাগাম টানা আরও কঠিন হবে। তিনি টিআইবির জরিপের প্রতিবাদ না করে দুর্নীতিবাজদের ধরতে সচেষ্ট হলে দুর্নীতির প্রকোপ অনেকটা কমানো যেত। ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়, কিন্তু যারা জেগে ঘুমায় তাদের জাগানো যায় না। ঘরের শোভা বর্ধন করার জন্য কাঠের বা মাটির বিড়াল নয়; এমন বিড়াল প্রয়োজন যে ইঁদুর মারতে পারে।