হলের দখলদারেরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল: তানজীমউদ্দিন

>
মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান
মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান
মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে (ডাকসু) একজন (আনঅফিশিয়াল) নির্বাচন পরিদর্শনকারী ছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর সহসম্পাদক তরিকুল ইসলাম

প্রশ্ন: আজ আপনি অনেকগুলো হলের নির্বাচনকেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। সেখানে কী দেখলেন?

তানজীমউদ্দিন: আমরা বেশ কয়েকটি হলের ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করি। যখন শুনলাম কুয়েত মৈত্রী হলে ভোট শুরু হওয়ার আগেই সিলমারা ব্যালট পেপারস পাওয়া গেছে, আমরা সেখানে যাই এবং সেটার সত্যতা পাই। আমরা কিছু ব্যালট পেপারস নিজেরাই দেখি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ক্রস চিহ্নগুলো নির্দিষ্ট প্যানেলেই দেওয়া ছিল। বুঝতেই পারছেন কাদের সেটা। এটা নিয়ে সেখানে উত্তেজনা ছিল। তখন আমরা হলের হাউস টিউটরদের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁদের দেখে আমদের খুব খারাপই লাগছিল। কারণ, তাঁরা বলছিলেন, ‘আমরা তিন মাস ধরে এত শ্রম দিলাম। কিন্তু সেটার পরিণতি এ রকম হলো। আমরা শিক্ষক হিসেবেও খুব লজ্জা পাচ্ছি।’ আমরা যখন কথা বলছিলাম, দুঃখজনক হলেও সত্য দুই-তিনজন শিক্ষক কেঁদেই দিয়েছিলেন।

কুয়েত মৈত্রী হলে ভোটের চিহ্ন দেওয়া ব্যালট পাওয়ার পর বিক্ষোভ শুরু করেন ছাত্রীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১১ মার্চ। ছবি: ফোকাস বাংলা
কুয়েত মৈত্রী হলে ভোটের চিহ্ন দেওয়া ব্যালট পাওয়ার পর বিক্ষোভ শুরু করেন ছাত্রীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১১ মার্চ। ছবি: ফোকাস বাংলা

প্রশ্ন: আপনারা কী জানতে পেরেছিলেন কীভাবে এই সিলমারা ব্যালট পেপারস সেখানে গেল?

তানজীমউদ্দিন: অনেক রকম ভার্সন আছে। মূল কথা হলো, ওই হলের রিডিং রুমের পাশে যে নামাজের ঘর আছে সেখানে ছাত্রীরা তিনটি বস্তা পেয়েছিল। আমরা ব্যালটগুলো নিজেরাই দেখি এবং সেগুলোতে নির্দিষ্ট দলের প্যানেলেই সিল মারা ছিল।
এরপর আমরা এ এফ রহমান হলে যাই। এফ রহমান হলের বুথ পর্যন্ত যাই। সেখানে অনেকেই বলছে, তারা অনেকক্ষণ ধরেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই সকালেই এসেছে কিন্তু লাইন এগোচ্ছে না। এর মধ্যে যারা বিএনসিসির সদস্য আছে, এই স্কাউটরা কিন্তু কোনো দলীয় কর্মী নয়, তারা বলল, সামনের দিকে লাইন এগোচ্ছে না এবং সামনে জটলা পাকিয়ে রাখা হয়েছে।
আমরা তখন বুথের কাছে গেলাম এবং দেখার চেষ্টা করলাম তারা কতক্ষণ ধরে ভোট দিচ্ছে। ভেতরে পরিবেশ ভালোই ছিল। কিন্তু একেকজন ভোটার অনেক সময় নিচ্ছিল। এরপর আমরা মুহসীন হলে যাই এবং সেখানে দেখি একজন সর্বোচ্চ ২২ মিনিট সময় নেয়। একেকজন গড়ে প্রায় ১৫ মিনিট সময় নিচ্ছিল। মুহসীন হলের সামনে দেখি সবাই ভোটকেন্দ্রের কাছেই মোবাইল নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। এমনকি একজনকে দেখলাম বুথের সামনে বসে আছে। যারা ভোট দিতে যাচ্ছে, তাদের ইনস্ট্রাকশন (নির্দেশনা) দিচ্ছে। আমরা তখন হাউস টিউটরদের জিজ্ঞেস করলাম, উনি ওখানে বসে আছেন কেন? তখন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন কর্মচারী বলেন, উনি অসুস্থ, তাই চেয়ার দেওয়া হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরই খেয়াল করি, তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বুথের কাছে এই জটলাটা একই ধরনের। আবার ওই জটলাকে কেন্দ্র করে তারাই মিছিল করছে। পুরো প্রক্রিয়াটার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, অনাবাসিক ছাত্রছাত্রীদের ভোট দেওয়া থেকে ঠেকানো। সূর্য সেন হলের গতিটা ভালোই ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনতে পাই, একজন আরেকজনকে বলছে অনাবাসিকদের ভোট নেই। তাকে এই বলে তাড়িয়ে দিল। পরে আমাদের দেখে বলছিল, ‘এই চুপ চুপ স্যাররা আসছে।’ সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলো, দুইটা পর্যন্ত লাইন ছিল। আবার দুইটার পরে দেখা গেল সে লাইনগুলো হঠাৎ আর নেই। উধাও।

আমাদের বলা হয়েছিল তিন মিনিট। কিন্তু, প্রকৃত অর্থে সেটা পাঁচ মিনিটের বেশি লাগার কথা। তবে সেটা ২০-২২ মিনিট নয়। আমরা লাইনে আবাসিক অর্থাৎ হলুদ কার্ডধারীদের বেশি দেখি। সামনের দিকে তারাই লাইনে ছিল।

রোকেয়া হলের তিনটি বাক্স ভেঙে ব্যালট পেপার বের করেন ছাত্রীরা। ছবি: দীপু মালাকার
রোকেয়া হলের তিনটি বাক্স ভেঙে ব্যালট পেপার বের করেন ছাত্রীরা। ছবি: দীপু মালাকার

প্রশ্ন: রোকেয়া হলে কী হয়েছিল?

তানজীমউদ্দিন: আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারিনি। তবে, কুয়েত মৈত্রী হলে যেহেতু এমন একটা ঘটনা ঘটে, তাই একটা ব্যালট বক্সে ব্যালট আছে, এমন একটা আশঙ্কা থেকে তারা সেটা দেখতে চেয়েছিল। পরে হল প্রভোস্টের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন যে আক্রমণটা করেছিল, সেটাই পুরো পরিস্থিতিটাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। মূলত অব্যবস্থাপনা ও ভুল-বোঝাবুঝি জিনিসটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়।

প্রশ্ন: গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না?

তানজীমউদ্দিন: নির্বাচনের বৈধতা, অবৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা আসলে বিষয় না। কখনো কখনো অব্যবস্থাপনাটা ইচ্ছাকৃত মনে হয়েছে। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভোট গ্রহণ হলো, সেটা শিক্ষক হিসেবে আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক। বৈধতা, অবৈধতা কোনো বিষয় না, বিষয় হলো আমরা শিক্ষক হিসেবে এটাকে কীভাবে দেখছি। আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের সম্মানবোধটা বিবেচনা না করি, তাহলে বৈধতা, অবৈধতা খুব একটা পার্থক্য তৈরি করে না।

প্রশ্ন: এই নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কী?

তানজীমউদ্দিন: আসলে, সরকারি ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে তো সব হলেই। এত দিন সেটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সেই দখলদারদের একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হলো, যেটা আমাদের কারোর জন্যই সুখবর নিয়ে আসবে না। বিশেষ করে আমরা যারা শিক্ষক হিসেবে ক্লাস রুমে যাই, আমাদের কাছে নৈতিক অবস্থানটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের একটা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শিক্ষক হিসেবে আমাদের নৈতিক অবস্থানটা অনেকটা এগুলোর সঙ্গেই মিলিয়ে গেল।
আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবজারভেশন হলো, ব্যালটগুলোর কোনো সিরিয়াল নম্বর ছিল না। অন্য নির্বাচনে যেমন ব্যালটের মুড়ি বই থাকে, সেটা ছিল না। যাঁরা ব্যালট দিচ্ছিলেন তাঁদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরাও সে সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেননি। আর কত ব্যালট ছাপা হয়েছে, সেটার কোনো তথ্য আমাদের দেওয়া হয়নি। কোনো ঘোষণাও নেই।