বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও নীলমণি উপাখ্যান

১৯৭০-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণনন্দিত জননায়ক। তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কেউ ছিলেন না। কিন্তু নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দেখা গেল, তাঁরও প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা খয়েরউদ্দিন। একজন অবিচল বাঙালি জাতীয়তাবাদী, আরেকজন কট্টর মুসলিম জাতীয়তাবাদী বা পাকিস্তানবাদী।

খাজা জানতেন, তাঁর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। বঙ্গবন্ধু জানতেন, তাঁর জয় ঠেকানোর সাধ্যি ভূপৃষ্ঠে কারও নেই। তারপরও খাজা দিনরাত পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরে তাঁর প্রচারণা চালিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সারা দেশ ঘুরে তাঁর দলের প্রার্থীদের জন্য ভোটারদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। পুরান ঢাকায় তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকায়ও কয়েক দিন গেছেন। যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। তবু ভোটারদের কাছে যেতে হয়।

হামিদুল হক চৌধুরীর কাগজ পূর্বদেশ ও পাকিস্তান অবজারভার খাজা খয়েরের সভা-সমাবেশের ব্যাপক প্রচার দিয়েছে। এক সাংবাদিক তাঁকে প্রথাগত প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বিজয়ের ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?’ সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি বাংলা-উর্দু মিশিয়ে বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের পরে জানা যাবে আমার সাপোর্টার কত?’ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল। ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেল, তাঁকে ভোট দিয়েছেন ৪৫ হাজার থেকে ৪৬ হাজার ভোটার।

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেই বিজয়ী হতে হবে এমন কথা নেই, তা সবাই জানেন। কখনো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। অনেকে স্রেফ পরিচিতি পাওয়ার জন্য নির্বাচন করেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই খুব জনপ্রিয় ও সর্বজনশ্রদ্ধেয়দের সঙ্গে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান না। তখন তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-এ বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াননি। সেটা ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো আরও কেউ কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, সোহরাব হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, মনোরঞ্জন ধর, জিল্লুর রহমান, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া প্রমুখ। ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ছিল।

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা যে ভালো নয়, সে সম্পর্কে তখন বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা করা হয়। প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা খোকা রায় লিখেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে ভাবী বঙ্গবন্ধু হওয়ার হাস্যকর প্রত্যাশা অনেক প্রার্থীর কাছেই একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে বিপদ ছিল, এমন অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু নির্বাচনপ্রার্থী জোরজবরদস্তি ও বলপ্রয়োগ করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পার হয়ে গেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর কথা স্বতন্ত্র। তিনি ছাড়া যে ১০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের অনেকের নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু কিছু বিরোধী দল যে আপত্তি তুলেছেন তার কোনো কোনো অভিযোগ যে একেবারে ভিত্তিহীন নয় এ কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হঠকারিতা যেমন ভয়াবহ, তেমনি এই বলপ্রয়োগ ও ভীতি প্রদর্শনও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের পক্ষে যে ভয়াবহ ও বিপজ্জনক, তা অস্বীকার করে লাভ নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর আসনে বসিয়েছে ইতিহাস।’ [সাপ্তাহিক সপ্তাহ, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩, কলকাতা]

সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া যতবার নির্বাচন করেছেন, তাঁদেরও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু বছর পাঁচেক ধরে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে নির্বাচন আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সমার্থক। সংসদ নির্বাচনের পরে এখন উপজেলা নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মহোৎসব। ৯৬ জন একেবারে পত্রপাঠ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। তার বাইরে যেখানে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে আসল প্রার্থীর সঙ্গে আছেন নামমাত্র প্রার্থী, পাতানো প্রার্থী, কোথাও একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী।

নির্বাচন কমিশন বা সরকারি দলকে আইনত ও ধর্মত দোষ দেওয়া যাবে না। তারা বলেনি যে তোমরা কেউ আমাদের প্রিয় প্রার্থীটির সঙ্গে মনোনয়নপত্র কিনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোরো না। কিন্তু বাস্তবতা অন্য জিনিস। অন্যদের বলপ্রয়োগে বাধা দেওয়া হয়তো হয়নি, কষে ধমক দিয়েও নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়নি, কিন্তু নজরুলের ভাষায় বলতে গেলে ক্ষমতাবানদের ‘রাসভ আঁখি অতি লাল’, যা দেখে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার জো! অনেকে তাঁর এলাকা ছেড়ে এসে রাজধানীতে ভায়রার বাসায় ঠাঁই নিয়েছেন।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াও গ্রহণযোগ্য হতো, যদি সবাই সরকারি দলের না হয়ে বিরোধী দলের অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংস্কৃতি বিরোধী দলের জন্য কোনো সমস্যা নয়। তারা বরং বেঁচে গেছে। এই তরিকার সংকট সরকারি দলের জন্যই। একই এলাকায় সরকারি দলের একাধিক জনপ্রিয় নেতা আছেন। জনগণ তাঁদের কাউকে উপজেলা চেয়ারম্যান দেখতে চান। তাঁদের বাদ দিয়ে অন্য এক ভাগ্যবানের যখন শিকে ছিঁড়ে, তখন সরকারি দলের নেতা–কর্মী ও সমর্থকদের হতাশা ও কষ্টের অন্ত থাকে না। তা ছাড়া জনগণ পরিণত হয় বর্জ্যবস্তুতে, যাদের দুই পয়সা দাম নেই।

বঙ্গীয় গণতন্ত্রের ষোলোকলা পূর্ণ করতে বিরোধী দলের নেতাদের ভূমিকাও যৎসামান্য নয়। নির্বাচনী নাটকে একটি ছোট্ট অধ্যায় এবার যোগ হলো। মনে দুঃখ–কষ্ট যা-ই থাক, ঐক্যফ্রন্টের যাঁদের নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁরা সবাই শপথ নিলে কারও কিছু বলার ছিল না। নির্বাচিত হলে শপথ নেওয়াই রীতি। তাঁদের গোত্রের সাকল্যে আধা ডজনের মধ্যে শপথ নিলেন মাত্র নীলমণি। সাফায়ার বা নীলমণি এক অমূল্য রত্ন। ভাগ্যবিড়ম্বনার মধ্যেও খালেদা জিয়া ভাগ্যবতী। তাঁর একমাত্র প্রতিনিধি সংসদে গিয়ে সংসদকক্ষ আলোকিত করেছেন তাঁর নামটিও উচ্চারণ না করে।

নিজেকে তিনি ‘নীলমণি’ হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। তিনি গণফোরামের প্রার্থী, বিএনপির প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে শপথ নিয়েছেন, এতে সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের একজনও অবাক হয়নি। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যাঁরা শপথ নিয়েছিলেন, তাঁদের তুলনায় নীলমণির শপথ কোনো ব্যাপারই নয়। বঙ্গবন্ধুর রক্ত তখনো শুকায়নি, আর খালেদা জেলখানায়। বাংলার মানুষ হতবাক হয়েছে অন্য কারণে। শপথ নেওয়ার পরে নীলমণি সংসদে যে ভাষণ দিয়েছেন, তা শুনে। গত ১০ বছর তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছেন, সংসদে দেওয়া ভাষণের বিষয়বস্তুর সঙ্গে তার আকাশ–পাতাল ফারাক।

নীলমণি একজন বলিষ্ঠ বক্তা। সংসদে তিনি বলেছেন, ১৮টি বছর তিনি ‘রাজনৈতিক কারাগারে’ ছিলেন। লুই কানের নকশার পুরু দেয়ালের ভেতরে এখন তিনি মুক্ত। আনন্দে আত্মহারা হওয়ায় তাঁর খেয়াল নেই, তাঁকে মুক্তি দিয়েছে ধানের শীষ। ওই অট্টালিকায় ঢোকার যখন এত ইচ্ছা, তিনি সঠিক পথেও যেতে পারতেন। শপথ না নিলে ৯০ দিন পরে আসনটি শূন্য হতো। সেখানে আবার নির্বাচন হতো। তখন তিনি উদীয়মান সূর্য হোক, মধ্যাহ্ন সূর্য হোক বা অস্তাচলগামী সূর্য হোক, যেকোনো প্রতীকে দাঁড়িয়ে ধানের শীষের বাইরের অন্যান্য ভোটারের সমর্থন নিয়ে শেরেবাংলা নগরের এই অট্টালিকায় আসতে পারতেন। কেউই বিশ্বাসঘাতক বলত না, বাহবা দিত। বাঙালি বিমূর্ত অনেক কিছুই ত্যাগ করতে পারে, নৈতিকতা ও বিবেক বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না, কিন্তু শুল্কমুক্ত দামি মোটরগাড়ি, সুবিধামতো জায়গায় রাজউকের প্লট, অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর বস্তু ত্যাগ করা তার জন্য আত্মহত্যার চেয়ে মারাত্মক।

সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই প্রাপ্য ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব, কিন্তু বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ৭ মার্চ তিনি বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রিত্ব আমি চাই না’। নিজের দল, নির্বাচনী জোট, নির্বাচনী বিধি এবং সবাইকে কলা দেখিয়ে নীলমণি বললেন—তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সাংসদ হওয়া চাই। এটাই একুশ শতকের বাংলাদেশ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক