ভিন্ন বিকল্পে জোর দেওয়া দরকার

বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাস্তবসম্মত সহায়তায় এগিয়ে আসা উচিত
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাস্তবসম্মত সহায়তায় এগিয়ে আসা উচিত

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে স্রোতের মতো রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকেরা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। সেখানে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে অনেক রোহিঙ্গা আগেও দুবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে—১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে। ১৯৭৮ সালে আসা আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে ১৯৭৯ সালের শেষাবধি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে স্বদেশে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। ১৯৯২ সালে আসা তিন লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় ২০ হাজার বাদে সবারই প্রত্যাবাসন হয়েছে একই ধরনের চুক্তির মাধ্যমে। বাংলাদেশে থেকে যাওয়া সেই ২০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে থাকছে, সেখানে তাদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। তা ছাড়া প্রায় চার দশক ধরে অল্প অল্প করে রোহিঙ্গাদের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ অব্যাহত আছে। তাদের সবাই যে শরণার্থী শিবিরেই থাকছে এমন নয়, কিছু অংশ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশে গেছে।

শিবিরে ও তার বাইরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন করা হয়েছে এবার, তাদের সংখ্যা এখন ১০ লাখের বেশি। তাদের বাসভূমি রাখাইন রাজ্যেও এখন এত রোহিঙ্গা নেই। মিয়ানমার সরকার আইন করে সংশোধিত নাগরিকত্বের তালিকা থেকে তাদের বাদ দিয়েছে। ২০১৭ সালে তাদের ওপর বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানো হয়। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ইত্যাদির শিকার হয়ে তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আমাদের দেশে পালিয়ে আসে। সীমান্তের কাছে বলে তারা আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায়। এ দুই উপজেলার লোকসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। তাদের ঘরে আজ ১০ লাখের বেশি অতিথি। তারা কবে স্বদেশে ফিরে যাবে বা আদৌ যাবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে দু-একটি চুক্তি হয়েছে, মিয়ানমার সরকার তা বাস্তবায়নে স্পষ্টতই আন্তরিক নয়।

পাশ্চাত্য বিশ্ব বাংলাদেশের এই মানবিক কার্যক্রমের প্রশংসা করছে, তারা কিছু বৈষয়িক সহায়তাও দিচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া ও চীনের বৈরী অবস্থানের কারণে জাতিসংঘ তার ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ভারত আমাদের ‘সব ধরনের সহযোগিতার’ কথা বলে, কিন্তু তেমন কিছু করে না। রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চায় না; কিন্তু সে জন্য তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ, রাখাইন রাজ্যে তাদের জীবনের নিরাপত্তা ফিরে আসেনি। আমরা তাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছি, আমাদের সরকারের মানবিক অবস্থানে কোনো নড়চড়ও হয়নি। তবু বলতেই হয়, কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের ওপর রোহিঙ্গা অতিথিদের ভার অনেক বেশি হয়ে গেছে; তারা একটা সমস্যাপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি।

শরণার্থী শিবিরের কাছাকাছি তাদের ফসলি জমি, মাছের ঘের, গাছের ফল ইত্যাদি সবকিছুর ওপর রোহিঙ্গাদের হাত পড়ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড়ের প্রক্রিয়া দ্রুততর হচ্ছে; হাতিসহ অনেক বন্য জীবজন্তুর নিরাপদ আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্রে মানুষের উপদ্রব আরও বাড়ছে। দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে ওই এলাকার পরিবেশ অস্বাস্থ্যকরও হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গারা শ্রমবাজারে ঢুকে পড়ায় স্থানীয় লোকজন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচর নামের একটি দ্বীপে ব্যয়বহুল শরণার্থী শিবির নির্মিত হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সেখানে লাখখানেক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা যাবে। তাতে উখিয়া-টেকনাফের সমস্যা সামান্যই মিটবে। এমন নয় যে এ রকম ব্যয়বহুল শরণার্থী শিবির দশটা স্থাপনের সামর্থ্য আমাদের আছে। জায়গার অভাব আছে, অর্থেরও অভাব আছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা কমে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। তারা আমাদের পরামর্শ দিচ্ছে, আমরা যেন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবাধ চলাচল ও কাজ করার সুযোগ দিই। রোহিঙ্গারাও এটাই চায়।

মিয়ানমারের রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর অবস্থানে পরিবর্তন না এলে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরামর্শ মেনে নিলে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ভার আমাদের জন্য স্থায়ী হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা তাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছি আপত্কালীন সময়ের জন্য, স্থায়ীভাবে নয়। সে সামর্থ্য আমাদের নেই। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশ আয়তনে খুবই ছোট; উপরন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে কৃষিজমির পরিমাণ দ্রুত কমে যাচ্ছে। ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও অর্থ আমরা কোথায় পাব? কর্মসংস্থানের অভাবে আমাদেরই লোকজন বিদেশে যাচ্ছে কাজের খোঁজে, এখানে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান কীভাবে সম্ভব?

উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনসংখ্যার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গার আশ্রয়ের নেতিবাচক দিকগুলো এখন সামনে আসছে; ভবিষ্যতে আরও আসবে। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ ঘটছে। ভবিষ্যতে এটা যে বড় সমস্যা রূপে দেখা দেবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশকে ওই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেওয়া খুব প্রয়োজন।

বাংলাদেশ যে মানবিক দায়বোধ থেকে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, আমরা চাই না তাতে কোনো কালিমা লাগুক। কিন্তু সমস্যাটির সমাধানের প্রয়াসও অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে। কূটনৈতিক পন্থায় সম্ভাব্য বিকল্পগুলো নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না। লোক দেখানো পদক্ষেপ হিসেবে যদি হাজার কয়েক ফিরিয়ে নেয়ও, তবু সমস্যা থেকেই যাবে। পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো দেশ অভিবাসী গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজেদের জনমিতির ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে।

সম্প্রতি জার্মানি ১০ লাখ সিরীয় উদ্বাস্তুকে স্থায়ীভাবে অভিবাসন দিয়েছে। এর পেছনে মানবিক দিকের পাশাপাশি জার্মানির ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যার বিষয়টি বিবেচনায় ছিল। বছর কয়েক আগে ভুটান থেকে বিতাড়িত এক লাখ নেপালি উদ্বাস্তুকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ভাগাভাগি করে নিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও এ রকম উদ্যোগ নেওয়া যায়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, দেশটির সরকার ও সামরিক বাহিনী তাদের পরিকল্পিতভাবে নৃশংস উপায়ে দেশছাড়া করেছে। বিশ্বের যেসব ধনী ও শক্তিধর দেশ এই অন্যায়ের প্রতিকারের উদ্যোগ নিচ্ছে না, বরং মিয়ানমারের সরকারকেই মদদ দিচ্ছে, তাদের আমরা কূটনৈতিকভাবে আস্থায় আনতে পারিনি।

বলা হতে পারে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অন্যান্য দেশে প্রত্যাবাসনের সুযোগ সৃষ্টি হলে মিয়ানমারে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গারাও এ দেশে চলে আসবে। কথাটা হয়তো একেবারে অমূলক নয়। তবে এ রকম প্রত্যাবাসন ছাড়াই তো তারা আসছে। তবে সীমান্ত সিল করায় সেভাবে আসতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও মালয়েশিয়াকে শ্রমশক্তি অস্থায়ীভাবে হলেও বিদেশ থেকে নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের দেশগুলোও অংশীদার হতে হবে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনের উচিত আমাদের এ সমস্যার একটি বাস্তবসম্মত সমাধানের প্রচেষ্টা দ্রুত নেওয়া।

আমরা আটকে পড়া পাকিস্তানিদের গ্রহণ করেছি। একসময় আন্তর্জাতিক রেডক্রস কিছু সাহায্য করত। এখন তারা ধারেকাছেও নেই। উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য চিরকাল একরকম থাকবে না। সময়ের সঙ্গে তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় পরিবর্তন আসে। এখন এটা যতটুকু নজরে আছে, তা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। আর এর দায়ভার আসবে বাংলাদেশের ওপরই। আর আমাদের দুটো উপজেলার মানুষের ওপর চাপ যত তাড়াতাড়ি কমানো ও শেষ করা যায়, সেদিকে বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা দরকার।

তৃতীয় দেশে প্রত্যাবাসনের ধারণাটি অভিনব বা অমূলক বলার সুযোগ নেই। সে রকম তৃতীয় দেশও আছে অনেক। বিশ্বসমাজ মিয়ানমারকে যখন বাগে আনতে পারছে না, তখন তাদের তাড়িয়ে দেওয়া ভাগ্যহত রোহিঙ্গাদের বাস্তবসম্মত সহায়তায় এগিয়ে আসা উচিত।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]