যুদ্ধ ও বিরোধে কার জয় হলো?

ভারত ও পাকিস্তানের উত্তেজনা আপাতত স্তিমিত হয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ইসলামাবাদ ভারতীয় বৈমানিক অভিনন্দন বর্তমানকে ফেরত দেওয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার দিকে। ভারতের দিক থেকেও বলা হয়েছে, ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি বজায় রাখতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। তার মানে, ভারত আপাতত পাকিস্তানের ভূখণ্ডে আর কোনো বিমান হামলা চালাবে না বলেই মনে হচ্ছে। এ ছাড়া কাশ্মীর সীমান্তে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি গুল ছোড়াও বন্ধ হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, পুলওয়ামা হামলার জের ধরে সৃষ্ট উত্তেজনা একটা অস্থায়ী প্রশমনের দিকে যাচ্ছে।

আগামী মাসেই ভারতে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচন সামনে রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বালাকোটে বিমান হামলার বিষয়টিকে প্রচারের কাজে ব্যবহার করতে চাইছেন। তিনি দেশবাসীকে বোঝাতে চাইছেন, পাকিস্তান ভারতের গায়ে ইট ছুড়লে বিজেপি পাটকেল ছুড়ে তার সমুচিত জবাব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ভারতীয়দের ক্ষোভের ওপর ভর করে মোদি পাকিস্তানকে এমন বার্তা দিতে চান যে ভারত আর আগের মতো শান্ত থাকার নীতিতে নেই। আঘাত এলে নয়াদিল্লি বড় ধরনের প্রত্যাঘাত দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণভাবে পরিস্থিতি শান্ত করায় উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি শান্তির কথা বলেছেন। কোনো ধরনের উসকানির দিকে তিনি যাননি। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রেখেছে। ভারত সরকার পাকিস্তানে হামলা চালানোর ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করে, ভারতের হামলাচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

অন্যদিকে ভারত দাবি করে, তারা পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে জইশ-ই-মুহাম্মদের ঘাঁটিতে যে হামলা চালিয়েছে, তাতে তিন শ জঙ্গি মারা পড়েছে। আসলেই ভারতীয় বিমানবাহিনী জঙ্গিদের ঘাঁটিতে হামলা করতে পেরেছে কি না, বা তিন শ লোক আদৌ মারা গেছে কি না, তা নিয়ে ভারতীয় জনগণের মধ্য এখনো সন্দেহ রয়ে গেছে। সময়ক্ষেপণ না করে আইএসপিআর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে দ্রুত ঘটনাস্থলে ঢোকার অনুমতি দেয়। রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস এবং আল-জাজিরার সাংবাদিকেরা সেখানে যান এবং তাঁরা তাঁদের প্রতিবেদনে বলেন, ভারত যেখানে হামলার কথা বলেছে, সেখানে কোনো জঙ্গি ঘাঁটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি এবং সেখানে এত সংখ্যক লোক মারা যাওয়ার আলামতও দেখা যায়নি। তাঁদের সে প্রতিবেদনের জবাবে ভারতের বিমানবাহিনী নিজেদের বয়ানের সপক্ষে জোরালো কোনো তথ্যও এখন পর্যন্ত দিতে পারেনি।

এর পরপরই পাকিস্তান গুলি করে একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করে এবং একজন পাইলটকে ধরে ফেলে। ইমরান খান দুই দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে পরে ওই পাইলটকে ছেড়ে দেন। পাইলটকে হস্তান্তরের দৃশ্য বিভিন্ন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের একধরনের নৈতিক জয় হয়েছে। তবে যতক্ষণ না পাকিস্তান সরকার জইশ-ই-মুহাম্মদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালাচ্ছে, ততক্ষণ তার সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান প্রমাণিত হবে না। এই জঙ্গি সংগঠনের নেতা মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করার জন্য ভারত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি তুললেও চীনের ভেটোর কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। পাকিস্তান যদি নিজ থেকে মাসুদ আজহারকে নিষিদ্ধ করে, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে। অবশ্য সে ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

সাধারণভাবে ধারণাটা এমন যে সাম্প্রতিক এই যুদ্ধ ও বিরোধে পাকিস্তানের বিজয় হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলামাবাদ পরাজয় ডেকে আনছে। কয়েক দিন আগে আবুধাবিতে ওআইসির সম্মেলনে অতিথি হিসেবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বক্তব্য দেন। তাঁকে যাতে বক্তব্য দিতে না দেওয়া হয়, সে জন্য পাকিস্তান ওআইসিতে আপত্তি তুলেছিল। সে আপত্তিকে অগ্রাহ্য করেই সুষমাকে বক্তব্য দিতে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের এই আপত্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিন্দিত হয়েছে। এর মাধ্যমে শান্তি ও সহাবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে পাকিস্তান সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছে।

আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে একইভাবে পাকিস্তান আপত্তি তুলেছিল এবং সেই আপত্তির কারণে ওআইসিতে ভারতকে আমন্ত্রণ জানানোর পর সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার পাকিস্তানের আপত্তি ধোপে টেকেনি। এতেও প্রমাণিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের মতামতের গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। সেখানে পাকিস্তানের নৈতিক পরাজয় হয়েছে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
অজয় শুক্লা: ভারতের সাংবাদিক ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল