ভাওয়াইয়া দেশের রাজা রে, ওহো মোর কালারে...

সফিউল আলম রাজা ভাই আর নেই। গতকাল (১৭.৩.২০১৯) মিরপুরে তাঁর গানের স্কুল কলতনে গিয়ে গৃহকর্মী সকালে দরজায় ডেকে না পেয়ে বাড়িওলাকে ডেকে নিয়ে দরজা ভেঙে দেখতে পান তিনি চির ঘুমে চলে গেছেন। বহুদিন তাঁর ঘুম ছিল না ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়। কোনো দিন আর জাগবেন না আর ভাওয়াইয়ার গাঢ় বেদনায়। আপনার গাওয়া ভাওয়াইয়া গানগুলোও আজ হাহাকার করছে।

প্রথম আলোতে আমার লেখা পড়ে কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি সফি খানের কাছ থেকে ফোন নম্বর জোগাড় করে স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন, ভাওয়াইয়া একাডেমির স্বপ্ন, ব্রহ্মপুত্রের পারে ব্রহ্মপুত্রের ঢেউয়ের শব্দে ছেলেমেয়েরা গলা ছেড়ে গাইবে, দেশ-বিদেশ থেকে গবেষকেরা আসবেন—এই স্বপ্ন। তাঁর গানের গুরু নুরুল ইসলাম জাহিদের ক্যানসার, তাঁর জন্য দুয়ারে দুয়ারে ছুটেছেন গুরু দক্ষিণা দেবেন বলে। কিন্তু তাঁরও পেট ক্ষুধায় ভরা ছিল ভাতের জন্য। ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো’ বলার মতো সাহস ছিল না বটে, তবে গাড়িয়াল ভাইয়ের মতো চিলমারীর চরের মোষের মতো জেদ ছিল বলে যে পত্রিকায় কাজ করতেন, সেখান থেকে পাওনা ২৩ লাখ টাকা না নিয়েই নীরবে চাকরি ছেড়েছেন। সর্বশেষ একটি অনলাইন পত্রিকা তাঁকে ‘যথাযোগ্য’ বেতন দিতে না পারার অক্ষমতা জানানোয় জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে বেকার ছিলেন। এরপর তাঁরই গাওয়া ‘ওকি ও পঙ্খী, কবার না পাং, সবার না পাং/ কান্দিয়া কান্দিয়া মরে’ গানের মতো সত্যই নিজের গাওয়া পঙ্খীর মতোই মরে গেলেন!

২.
দুজনেই চিলমারী হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। এই হাইস্কুলের শিক্ষকদের কেউ ৭০–এর সাংসদ ছিলেন, কেউ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন, কেউ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, কেউ ন্যাপ নেতা ছিলেন, কেউ কমিউনিস্ট পার্টির আর বাকিরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সব শিক্ষকের বর্ণাঢ্য জীবন ছিল। ফলে স্কুলটি সারা বছর শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে মেতে থাকত। আমরা যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই, এর দু–তিন বছর আগে মেট্রিক পাস করে ওনারা বেরিয়ে গেছেন। তবে স্কুলের প্রোগ্রামগুলোতে তিনি অতিথি শিল্পী হিসেবে আসতেন।

‘ওরে ভাবের ছলে মজাইলেন মন/ বানাইলেন মোক বাউদিয়া’—এরপর কোন দিন যে বাউদিয়া (ভবঘুরে) হয়ে সাংবাদিক হয়ে ঢাকায় চলে গেলেন, বিখ্যাত শিল্পী হলেন, জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ক্রাইম রিপোর্টার হলেন, আমরা জানলামও না। তাঁর নামে চলা গল্প আমরা শুনতাম, একদিন জানলাম, আমাদের মুকুট ভাই নাকি তাঁর ছোট ভাই। তিনি চখোয়া (চকোর) পাখির মতো উড়তে চেয়েছেন কিন্তু ঢাকা শহরের ফান্দে পড়ে ছটফট করেছেন: ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে...!

দু–তিন বছর আগে কুড়িগ্রামের কৃতী সন্তানদের সংবর্ধনার নামে বিসিএস ক্যাডারদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে তিনি গান গাইতে এলে সংবর্ধনাস্থলের পাশে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, ছবি তুলি। কিন্তু দেশখ্যাত সফিউল আলম রাজা কৃতী সন্তান নন, তাঁকে কেউ সংবর্ধনা দেয়নি। আজকেও সকালে যখন কুড়িগ্রাম শহীদ মিনারে ও চিলমারীতে জানাজা হয়, সেখানেও সরকারি-বেসরকারি বড় কোনো ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন না! ইতিহাস সাক্ষী, কুড়িগ্রামে কত মন্ত্রী-এমপি, ডিসি-এসপি রাজ করেছেন কিন্তু আব্বাসউদ্দীন একদিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য চিলমারীতে এসেই অমর হয়ে গেছেন! সফিউল আলম রাজার জন্যও ইতিহাস তেমন জায়গাই নির্ধারণ করবে—এ বিশ্বাস রাখি।

৩.
তাঁর গলায় বাহের দেশের নারীর বেদনা ও আনন্দ গান হয়ে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ত। ‘ওকি হায় রে হায়/ মনটায় মন পিঠে খাবার চায়’—রাজা ভাইও কি পিঠা খেতে চেয়েছেন? কিন্তু পিঠা খাওয়ানোর জন্য যে দরদ লাগে, ঢাকা শহরে তা কি আছে? ঢাকা শহর আমাদের কারও শেষ ঠিকানা নয় ভাই। দেখেন না, মাওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলে ফিরে গেছেন, শেখ সাহেব টুঙ্গিপাড়ায়। সৈয়দ হকও ফিরেছেন কুড়িগ্রামে, আপনিও শেষযাত্রায় চিলমারী এসে ভালো করেছেন ভাই। এখন মণ্ডল স্যারের সঙ্গে মিটিং করেন, হামরা আছি ভাই। ভাওয়াইয়া একাডেমি বানা নাইগবের নয়? ও মোর কালারে ও মোর ভাইও রে...।

৪.
ফারুক ওয়াসিফ ভাওয়াইয়া গানের প্রেমে পড়ে লিখেছিলেন ‘বাহের দেশে ভাওয়াইয়া নারীর ব্যথা’। রাজা ভাইয়ের মৃত্যুতে তাঁর শোক আমাদের স্পর্শ করে। ফেসবুক থেকে নেওয়া তাঁর কথা দিয়েই শেষ করি:

‘আহারে রাজা ভাই। বাহের দেশের ভাওয়াইয়া ভাই রে আমার। মরার দেশে জীবনটা জীয়াতে পারলেন না! রবীন্দ্রনাথের কথা, জগতে যোগ্য লোক আছে কিন্তু তাকে দেখাবার যোগ্য মঞ্চ মেলে না। আপনার বেলায় সেটাই করুণ কঠিন সত্য হলো।

‘আপনার জায়গায় অন্যে হলে কী করত জানি না। কিন্তু একসময় বুকের জল সব শুকিয়ে যায়, শুষে নেয় মহাজনেরা। সেই দুর্দিনের কথা এই বুকজলে দাঁড়িয়ে ভাবা যায় না। সাংবাদিক ছিলেন। পাওনা পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠান। কাজপাগল মানুষটা কাজ ছাড়া বসে ছিলেন। রংপুরে সাধের ভাওয়াইয়া একাডেমি করার জেদ ছাড়েননি। ভাওয়াইয়ার আবেগে আপনি শেষ হয়ে গেলেন। এ মৃত্যু স্বাভাবিক না, স্বাভাবিক না। আপনার গানের গুরুর চিকিৎসার জন্য হন্যে হয়ে টাকা জোগাড় করেছেন, আর নিজের বেলায় অভিমানে গুটিয়ে নিলেন বাকিটা আয়! আহারে রাজা ভাই, আহারে।

আহারে দারুণ বিধি, ফান্দে পড়িয়া বগা আর কানতেও পারবে না!’

নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক।
[email protected]