পাহাড়ে আবার হত্যা

গত সোমবার রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে ব্রাশফায়ারে সাত ব্যক্তির নিহত হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এক সূত্রে গ্রথিত হোক বা না হোক, ঘটনা দুটি অতিশয় উদ্বেগজনক। এর শেষ কোথায়?

সোমবার রাঙামাটির বাঘাইছড়ির নয়মাইল এলাকায় ভোট গ্রহণ ও গণনা শেষে গাড়িতে করে ফেরার সময় নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ সাতজন নিহত হন। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক এলাকায় নির্বাচন শেষে ফলাফল ও সরঞ্জাম নিয়ে তাঁরা উপজেলা সদরে ফিরছিলেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন পোলিং কর্মকর্তা, দুজন নারী আনসার সদস্য রয়েছেন। অন্যদিকে মঙ্গলবার সুরেশ কান্তি কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে ফারুয়ার ওরাছড়ি থেকে ট্রলারযোগে বিলাইছড়ি সদরে আসার পথে রাইংখ্যং নদী ধরে আলীখ্যং এলাকায় পৌঁছালে অস্ত্রধারীরা তাঁকে গুলি করে।

নির্বাচনকে ঘিরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটলেও এর পেছনে যে দীর্ঘদিনের গোষ্ঠীগত বিরোধ কাজ করেছে, তা ধারণা করা যায়। সারা দেশে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে চাপান-উতোর চললেও প্রাণঘাতী ঘটনা বেশি ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামেই। দুই দিনে আটজনের প্রাণহানির ঘটনা প্রমাণ করে, সেখানকার জননিরাপত্তা কতটা ভঙ্গুর। রক্তক্ষয়ী সংঘাত অবসানের লক্ষ্যেই ১৯৯৭ সালে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই হয়েছিল, যা পার্বত্য চুক্তি হিসেবে পরিচিত। দুর্ভাগ্য, দুই দশক পরও সেখানে শান্তি আসেনি। আর সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি উপস্থিতি ও তৎপরতা রয়েছে।

গত দুই দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটেছে একাধিকবার। পার্বত্য চুক্তি সইকারী জেএসএস ও চুক্তির বিরোধিতাকারী ইউপিডিএফ—দুই সংগঠনই এখন বিভক্ত। বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচনে ইউপিডিএফ ও জেএসএস এক পক্ষে ছিল। জেএসএস থেকে বেরিয়ে আসা লারমা গ্রুপ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও আওয়ামী লীগ আরেক পক্ষ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে জেএসএস লারমা গ্রুপ জিতে গেলে প্রতিপক্ষ কারচুপির অভিযোগ আনে।

তবে শুধু নির্বাচনী বিরোধই সেখানে সংঘাতের একমাত্র কারণ নয়।

১৯৭২ সালে পাহাড়ের মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য জেএসএস গঠিত হয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি হওয়ার পর ইউপিডিএফ নামে নতুন দল গঠিত হয়। পরে ২০১০ সালে মূল জেএসএস ভেঙে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। ২০১৫ সালে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে খুনোখুনি প্রায় বন্ধ ছিল। তবে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ ভেঙে আরও একটি নতুন দল গঠিত হয়। ইউপিডিএফের সাবেক নেতা তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে নতুন সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে পাহাড়ের দুই জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে আঞ্চলিক দলগুলো বিভিন্ন সময়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। গত ১৫ মাসে এসব সংঘাতের ঘটনায় ৫৮ জন নিহত হয়েছেন।

 নির্বাচনে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো আলামত দেখা গেল না। উপর্যুপরি সংঘাতের পরও তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আটজনের প্রাণহানির ঘটনার পর সেখানে শান্তি বজায় রাখা ও নতুন করে সহিংসতা ঠেকানো যাবে কি না, তা নির্ভর করছে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার ওপর। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যেকোনো মূল্যে পাহাড়ে রক্তপাত থামাতেই হবে।