মধ্য মার্চেই অপারেশন সার্চলাইটের সিদ্ধান্ত

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে গণবিদ্রোহ
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে গণবিদ্রোহ

একাত্তর সালের ১ মার্চের পর দেশের চালচিত্র আমূল পাল্টে গিয়েছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা শোনামাত্রই বাঙালি জাতি ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। এমন গণবিদ্রোহের নজির স্মরণকালের ইতিহাসে নেই।

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের অসামরিক বিষয়গুলো দেখভাল করতেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁকে রাওয়ালপিন্ডির সেনাসদরে ডেকে পাঠালেন। যাওয়ার আগে ৩ মার্চ রাত ১১টায় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসায় যান মুজিবের মন বোঝার জন্য। ফরমান আলী জানতে চান, পাকিস্তানকে বাঁচানো যায় কি না। শেখ মুজিবের জবাব ছিল, ‘যায়, যদি আমাদের কথা কেউ শোনে। সেনাবাহিনীর হাতে অনেক মানুষ মারা গেছে। তারা শুনছে ভুট্টোর কথা। তারা আজ অবধি আমার সঙ্গে কথা বলেনি। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও আমরা আলোচনা করতে ইচ্ছুক।’

তাঁদের কথাবার্তার একপর্যায়ে ঘরে ঢোকেন তাজউদ্দীন আহমদ। রাও ফরমান আলীর জিজ্ঞাসা ‘পাকিস্তান রক্ষা পাবে কি না’—এ ব্যাপারে তাজউদ্দীনের মতামত জানতে চান শেখ মুজিব। তাজউদ্দীন বললেন, ‘হ্যাঁ, রক্ষা পেতে পারে, তবে নতুন এক ফর্মুলায়। এত নৃশংসতার পর ভুট্টোর সঙ্গে এক ছাদের নিচে আমরা আর বসতে পারি না। কারণ, বাঙালিদের চোখে সে হলো এক নম্বর খুনি। ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলা যায়, যদিও সে দুই নম্বর খুনি। পরিষদের অধিবেশন বসার তারিখ নিয়ে ভেটো দেওয়ার কারণে ভুট্টোর সঙ্গে কোনো আলোচনায় যাওয়া আর সম্ভব নয়। সবকিছুর জন্য সে দায়ী। জাতীয় পরিষদ দুই ভাগ হয়ে যাক—একটি পূর্ব, আরেকটি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। প্রতিটি পরিষদ তার নিজ অংশের জন্য একটি সংবিধান লিখতে পারে।’ রাও ফরমান আলীর মনে হলো, এটি একটি কনফেডারেশনের ফর্মুলা, ফেডারেশনের নয়। (সূত্র: রাও ফরমান আলী, হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড)।

পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ৪ মার্চ ঢাকার রাস্তা থেকে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেন। কার্যত ওই দিনই তিনি বাংলাদেশে ‘পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব’ ছেড়ে দেন। ৫ মার্চ তিনি সামরিক আইন প্রশাসকের পদের ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘সামরিক ব্যবস্থা মীমাংসার কোনো পথ নয়।’ (সূত্র: ওই)।

৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবের ভাষণে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার প্রতি হুমকি ছিল খোলাখুলি, ‘আমরা তোমাদের ভাতে মারব, আমরা তোমাদের পানিতে মারব।’ ঢাকা সেনানিবাস তখন থেকেই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি ঠিকাদারেরাও তাঁদের খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের ‘অহিংস-অসহযোগ’ আন্দোলনের ছিল এমনই শক্তি।

ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অধ্যাপক হেনরি কিসিঞ্জারের কথা হয় ১০ মার্চ। নিক্সনকে তিনি বলেছিলেন, ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করবে। তবে সামরিক অভিযান সফল না-ও হতে পারে। শেখ মুজিব গান্ধীর মতো অসহযোগ আন্দোলন করছেন। এই আন্দোলন দমন করার জন্য যুক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। একটি দীর্ঘমেয়াদি বিদ্রোহ শুরু হলে তা দমন করার সামর্থ্য পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নেই। প্রেসিডেন্টকে চুপচাপ থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো হবে নিষ্ক্রিয় থাকা এবং কিছুই না করা, যাতে ইয়াহিয়া আপত্তিকর কিছু মনে না করেন। গৃহযুদ্ধ এড়ানোর বল এখন ইয়াহিয়ার কোর্টে। এ সময় কিছু বলা উচিত হবে না। কেননা পরিস্থিতির ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা কিছু বললে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাকে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ মনে করতে পারে এবং এর ফলে ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে। পাকিস্তান এক আছে, এটা মনে করাই হবে সুবিধাজনক। আমাদের কোনো পদক্ষেপ যেন বিচ্ছিন্নতাকে উসকে না দেয়।’ (সূত্র: গ্যারি জে বাস, দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম)।

এই প্রেক্ষাপটে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য ঢাকা আসতে চাইলেন। তবে সম্ভাব্য ‘বিরূপ সংবর্ধনা’র মুখোমুখি হতে চাচ্ছিলেন না তিনি। ১২ মার্চ রাওয়ালপিন্ডি থেকে একজন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা ঢাকায় এসে তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে চান। কামাল হোসেন বিষয়টি শেখ মুজিবকে জানালে তিনি কামালকে ওই কর্মকর্তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে বলেন। কর্মকর্তাটি বলেন, ইয়াহিয়া যদি ঢাকায় আসেন, তাহলে মুজিব তাঁর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হাউসে দেখা করবেন কি না। এ প্রশ্ন তিনি করছেন, কারণ এর আগে মুজিব গভর্নর হাউসে গিয়ে টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেছিলেন। মুজিব বলেছিলেন, টিক্কা খানকে তাঁর বাসায় এসে দেখা করতে হবে। এটি পরিষ্কার হওয়া দরকার। মুজিব ইয়াহিয়াকে তাঁর বাসায় আসতে বলবেন কি না। কামাল হোসেন বিষয়টি শেখ মুজিবকে জানালে মুজিব বলেন, তিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর পছন্দমতো জায়গায় দেখা করবেন। সেটি প্রেসিডেন্ট হাউসও হতে পারে। তবে তিনি যদি তাঁর বাসায় আসেন, তাঁকে স্বাগত জানানো হবে। (সূত্র: কামাল হোসেন, বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস)।

ইতিমধ্যে ভুট্টো সংবিধান প্রশ্নে একটি ফর্মুলা ঠিক করে ফেলেছেন। এতে ৩ মার্চ রাতে রাও ফরমান আলীকে দেওয়া তাজউদ্দীনের প্রস্তাবের মিল আছে। ১৪ মার্চ লারকানায় এক জনসভায় ভুট্টো বলেন, সংবিধান তৈরির আগেই যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হয়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের কাছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির কাছে তা করতে হবে। তারপর সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দুটি দলকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান তৈরি করতে হবে। (ডন, ১৫ মার্চ ১৯৭১)।

ভুট্টোর কথার অর্থ দাঁড়ায়, পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ আবার ‘এক ইউনিট’ হয়ে যাবে এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতার বিন্যাস ঠিক হওয়ার আগেই দেশে দুটি ‘সার্বভৌম অঞ্চল’ তৈরি হবে।

বোঝা যাচ্ছিল, শেখ মুজিব যা চাচ্ছিলেন, ভুট্টোও একই পথে পা বাড়াচ্ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের প্রশাসন মুজিবকেই খলনায়ক বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং একটি ‘সামরিক সমাধানের’ যুক্তি খুঁজছিল।

ইয়াহিয়া ঢাকায় এলেন ১৫ মার্চ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আইন উপদেষ্টা বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের চিফ অব স্টাফ জেনারেল পীরজাদা, আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল আকবর, গোয়েন্দা ব্যুরোর পরিচালক এন এ রিজভী এবং পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান এম এম আহমদ।

প্রশাসন যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে, সে জন্য ১৫ মার্চ শেখ মুজিব ৩৫টি বিধি জারি করেন। প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এটি জানিয়ে দেন তাজউদ্দীন। ইয়াহিয়ার ঢাকায় আসা এবং একই সময় এ ধরনের প্রশাসনিক বিধি জারি করার মধ্যে ইঙ্গিতবহ তাৎপর্য আছে। বিষয়টি মোটেও কাকতালীয় নয়। এই বিধিমালার মাধ্যমে শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রশাসন নিজের হাতে নিয়ে নেন। ইয়াহিয়া তখন সত্যিকার অর্থে আর প্রেসিডেন্ট নন। তিনি একজন অতিথি।

সেনাবাহিনীর কট্টরপন্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জেনারেল আবু বকর ওসমান মিঠা, খুদাদাদ খান, ইফতেখার জানজুয়া ও গোলাম উমর। তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ দমনের জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাঁদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সামরিক জান্তার ধারণা ছিল, ঢাকায় অবস্থানরত ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক খাদিম হোসেন রাজা এবং রাও ফরমান আলী অতটা কঠোর হতে পারবেন না। (সূত্র: লে. জেনারেল কামাল মতিনউদ্দিন, ট্র্যাজেডি অব এররস)।

১৬ মার্চ বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্ট হাউসে শেখ মুজিব আসেন গাড়িতে কালো পতাকা লাগিয়ে। শুরু হয় তাঁদের ‘আলোচনা পর্ব’। ওই দিনই টিক্কা খান খাদিম হোসেন রাজা ও রাও ফরমান আলীকে সামরিক অভিযানের একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে বলেন। এ পরিকল্পনার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। (সূত্র: মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ, যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১)।

মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার আলোচনা ছিল লোক দেখানো। সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি, কী ভয়ংকর পরিণতি ধেয়ে আসছে!

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]