কারোরই কি কিচ্ছু করার ছিল না?

ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী আন্তনগর ট্রেন ধূমকেতু ছুটছিল। আমাদের সিটটা ছিল পেছনের দিকে। বেশ কয়েকবার চোখে পড়ল মধ্যবয়স পেরিয়ে আসা এক নারীকে। ফুটফুটে নাতনিকে নিয়ে তিনি বাথরুমে গেলেন দুই থেকে তিনবার। মুখটি ছিল মলিন।

ট্রেন তখন আবদুল্লাহপুরে। এখান থেকে রাজশাহী পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। নামার আগে শেষবারের মতো ট্রেন থেকে কেনা গরম গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছি। ছুটির দিন। তাই ট্রেনে ভিড়টা একটু বেশিই ছিল। বাথরুমের দরজার কাছে ছোটখাটো জটলাও ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কয়েকজন বলতে শুরু করলেন, একজন নারী বাথরুমে পড়ে গেছেন।

চট করে মাথায় মধ্যবয়সী ওই নারীর কথা এল। গিয়ে দেখি সত্যিই তাই। বাথরুমে পড়ে আছেন তিনি। খবর পেয়ে সামনের সিট থেকে ছুটে এলেন তাঁর মেয়ে। সঙ্গে দুই শিশু আর মাকে নিয়ে তিনি রাজশাহী যাচ্ছিলেন। সবাই মিলে মধ্যবয়সী ওই নারীকে নিয়ে আসা হলো বাথরুম থেকে। বসানো হলো আসনে। কেউ মাথায় পানি দিচ্ছেন। কেউ বাতাস করছেন। কিন্তু তাঁর অবস্থা ভালো ছিল না। মুখ বেঁকে আসছিল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে থাকা মেয়েটি অসহায়ের মতো বলছিলেন, ‘আমি এখন কী করব? কোথায় যাব?’ কোলের শিশুটিও কেঁদে যাচ্ছে একটানা।

সবাই ভাবছিলেন, একজন চিকিৎসক দরকার। কামরায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল চিকিৎসক নেই। কিন্তু পুরো ট্রেনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো চিকিৎসক থাকবেন। প্রথমেই মাথায় এল রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে কর্মকর্তাদের কথা। কয়েকজন যাত্রী ছুটে গেলেন। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের কাউকে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল কর্তব্যরত রেলওয়ের দুজন পুলিশকে। এতক্ষণ যাঁরা অসুস্থ ওই নারীকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন, তাঁরা কিছুটা হাঁফ ছাড়লেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি।

ঘটনাস্থলে রেলওয়ে পুলিশকে আরও অসহায় দেখাল। তাঁরা বারবারই বলতে থাকলেন, ‘এখন ট্রেন থামানো সম্ভব নয়।’ বলা হলো, ‘ট্রেনে চিকিৎসক খুঁজে বের করতে। একটা মাইকিং যদি করা যায়।’ তাঁরা জানালেন, ‘মাইকিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। স্টেশন এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ডে নাম জানানো হয়।’ আমরা অনুরোধ করলাম, ‘অন্তত আপনারা কামরায় কামরায় গিয়ে চিকিৎসক কে আছেন খুঁজে বের করুন।’ তাঁরা নির্বিকার উত্তর দিলেন, ‘কেউ আসবে না।’ এরপর একজন চিকিৎসকের মতো করেই বললেন, ‘ওনার হার্টে চাপ দিন। ঠিক হয়ে যাবেন।’

এর মধ্যেই অসুস্থ ওই যাত্রী দুইবার বমি করেছেন। তাঁর মেয়ে জানালেন, মা হৃদরোগে ভুগছেন। তিনি (অসুস্থ যাত্রী) ভারতের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠির চিকিৎসা নিচ্ছেন। শিগগিরই তাঁকে নিয়ে আবার ভারতে যাওয়ার কথা। ভারতে যাওয়ার আগে তিনি রাজশাহীতে নিজের বাড়িতে যাচ্ছেন। এর মধ্যেই এমন বিপদ।

যাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন দোয়া পড়তে শুরু করলেন। অসুস্থ নারীকে সবাই মিলে সান্ত্বনা দিতে শুরু করলেন। ‘খালাম্মা আর একটু। একটু পরেই আমরা রাজশাহী নামব।’

একবার ফোন করলাম সরকারি স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ নম্বরে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরামর্শটুকু যদি পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যরত চিকিৎসক ফোনও ধরলেন। কিন্তু ট্রেনের শব্দে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। অসুস্থ নারীর মেয়েও ফোনে গুছিয়ে কিছু বলতে পারলেন না। তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বারবার বললেন, ‘আমার মা শেষ হয়ে যাবেন।’

ট্রেন রাজশাহীর কাছাকাছি চলে এল। অসুস্থ নারী এবার একটু কথা বলতে পারলেন। বললেন মাথায় পানি দিতে।

আমাদের বগিটি ছিল ‘ড’। ট্রেনের একেবারে শেষ বগি। রাজশাহী স্টেশনে পৌঁছানোর পর বগি থামল প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে। রেলওয়ে কর্মকর্তারা চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ যাত্রীকে কোনো সহায়তা দিতে পারেননি। ট্রেন থামার পরও তাঁদের কাউকে দেখা গেল না। এই অসুস্থ নারী কীভাবে ট্রেন থেকে নামবেন, তা নিয়ে ভাবনার কোনো অবকাশ নেই তাঁদের।

এবারও সহযাত্রীরাই ভরসা। এর মধ্যেই অবশ্য মেয়ে তাঁর এক স্বজনকে ফোন করে নিয়ে এসেছেন। ভদ্রলোক ও সহযাত্রীরা মিলে অসুস্থ নারীকে ধরে সামনের বগির দিকে এগিয়ে নিলেন। যাত্রীদের কাঁধে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে বেশ অনেকটা হাঁটতে হলো তাঁকে। যাত্রীরা অসুস্থ নারীকে নামিয়ে স্টেশনে বসালেন। নারীর স্বজন জানালেন, তাঁরা দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।

সবাই যে যার গন্তব্যে ছুটলেন। ছুটলাম আমিও। তাড়াহুড়োতে ওই অসুস্থ নারীযাত্রী বা তাঁর মেয়ের ফোন নম্বর আর নেওয়া হলো না। সেই অসুস্থ নারী যাত্রী এখন কেমন আছেন জানি না। চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হওয়ায় তাঁর শারীরিক কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, তা–ও জানা নেই। তবে প্রশ্ন জাগে, প্রতিদিন চলন্ত ট্রেনগুলোতে যে যাত্রীরা যান, তাঁদের দেখাশোনার দায়িত্ব আসলে কাদের? আন্তনগর ট্রেনে অসুস্থ যাত্রীকে সেবা দেওয়ার কোনো বন্দোবস্ত থাকবে না? যাত্রাপথে কারও অসুস্থ হয়ে পড়া কি খুব অস্বাভাবিক?

ঘটনাস্থলে রেলওয়ের যে দুজন পুলিশ এসেছিলেন, তাঁরা যেন দায় এড়াতে পারলেই বাঁচেন। একজন জানিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে কিছু ওষুধ আছে। আরেকজন বললেন, না না তা দিয়ে ক্ষতি হলে আবার তাঁদের ওপর দোষ পড়বে।

অসুস্থ ওই যাত্রীর জন্য রেলওয়ের কর্তব্যরত কর্মীরা অনেক কিছুই করতে পারতেন। তাঁরা কাছাকাছি কোনো স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে চিকিৎসকের খোঁজ নিতে পারতেন। পুরো ট্রেনে খোঁজ করে নিশ্চয়ই কোনো চিকিৎসককে ডাকতে পারতেন। অন্তত ট্রেন থেকে নামার সময় ওই যাত্রীকে সহায়তা করতে পারতেন। সহায়তা করতে পারতেন তাঁকে স্টেশন থেকে হাসপাতালে নেওয়ার বন্দোবস্ত করতেও। এসবের কোনোটাতেও তাঁদের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ‘আমাদের কী করার আছে?’ এই বলেই দায়িত্ব শেষ করেছেন তাঁরা। সত্যিই কী এমন সব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিচ্ছু করার নেই? কর্তব্যরত রেলওয়ে পুলিশরাই কি ঠিক বলছেন? নাকি সাধারণ যাত্রীরাই তাঁদের কাছে বেশি প্রত্যাশা করছেন?

শুভা জিনিয়া চৌধুরী: সাংবাদিক
([email protected])