সস্তা শ্রমনির্ভর অর্থনীতি

ছোট্ট ভূখণ্ডে অত্যধিক জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সুশাসনের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, ঘুষ-দুর্নীতি, অদক্ষ বন্দর ও যোগাযোগব্যবস্থা ইত্যাদি নানা সমস্যা সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এটাকে ‘বাংলাদেশ মিরাকল’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে অর্থনীতি যেহেতু মানুষেরই কর্মতৎপরতার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ব্যাখ্যাতীত কোনো অলৌকিক বা মিরাকুলাস বিষয় নয়। এর কিছু ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে।

প্রথমত, বাংলাদেশ অদম্য প্রাণশক্তির অধিকারী, আশাবাদী, পরিশ্রমী মানুষের দেশ। একদিকে সীমিত ভৌগোলিক আয়তনের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা, অন্যদিকে অতি উচ্চমাত্রার জনঘনত্বের ফলে সৃষ্ট নানা রকমের বাস্তবিক প্রতিকূলতার মুখেও বাংলাদেশের মানুষের বিপুল কর্মোদ্যম জাতীয় অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। আর যেসব কারণে কোনো দেশের অর্থনীতিতে ধারাবাহিকভাবে অগ্রগতি ঘটে, সেগুলো পরিমাপের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় সেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের তুলনামূলক চিত্র নিয়মিতভাবে তুলে ধরা হয়। অবকাঠামোগত সুবিধা-অসুবিধাসহ জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক পরিবেশের বৈশ্বিক চিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো নয়।

যেমন বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স’ (কোন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রিক পরিবেশ কতটা অনুকূল) বা সহজে ব্যবসা করাবিষয়ক সূচকে পৃথিবীর ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। নেপাল, ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ, এমনকি প্রায় দুই যুগ ধরে যুদ্ধকবলিত দেশ আফগানিস্তানের অবস্থানও আমাদের চেয়ে এগিয়ে। বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেক্সেও বাংলাদেশ রয়েছে ৯৯টি দেশের চেয়ে খারাপ অবস্থানে। এই সূচকের তালিকাভুক্ত ১৬০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য সাধারণভাবে যে অনুকূল পরিবেশ থাকতে হয়, বাংলাদেশে তার অভাব প্রকট। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যেমনটি বলেন, সচরাচর যেসব মানদণ্ড দেখে কোনো বিনিয়োগকারী কোনো দেশে বিনিয়োগ করতে যান, তার অধিকাংশই বাংলাদেশে অনুপস্থিত।

ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিসঞ্চারের জন্য বন্দরসুবিধাসহ আমদানি-রপ্তানির সব পথ সুগম হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বন্দরব্যবস্থা হতাশাব্যঞ্জক রকমের অদক্ষ। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে বিদেশ থেকে পণ্যসহ কোনো জাহাজ এসে ভেড়ার পর সেটা থেকে পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া শেষ করতে গড়ে ১৫ দিনের বেশি সময় লেগে যায়। অথচ একই প্রক্রিয়া শেষ করতে দক্ষিণ কোরিয়ার বন্দরে লাগে ৪ দশমিক ৪ দিন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অবস্থান বৈশ্বিক কোনো সূচকেই ভালো নয়।

এই প্রতিকূল পরিবেশেও যে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে, তার একটা বড় কারণ হলো এই যে এ দেশে খুব সস্তায় শ্রম কেনা যায়। জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, উৎপাদনশীল খাতের শ্রমিক, কারখানার প্রকৌশলী, উৎপাদন খাতের ব্যবস্থাপক ও সেবা খাতের ব্যবস্থাপকদের মজুরি ও বেতন বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম। শ্রমিকের মজুরি বাংলাদেশে মাত্র ১০৯ মার্কিন ডলার (প্রায় ৯ হাজার টাকা), কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও যা দ্বিগুণের বেশি (যথাক্রমে ২০১ ও ২২৭ ডলার), আর ভারতে ২৬৫ ডলার।

সস্তা শ্রমের কারণে শিল্পমালিকদের উচ্চ মুনাফা লাভ—এ অবস্থা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান কারণ হলে সেটা কত দিন টেকসই হবে, তা একটা বড় প্রশ্ন। তা ছাড়া এতে যে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়, তারও নেতিবাচক ফল আছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সব ধরনের বৈশ্বিক সূচকে অগ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে বন্দরের দক্ষতা, সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।