কী চাইছে শোকাতুর পুরান ঢাকা?

সর্বনাশা সেই অগ্নিকাণ্ডের ঠিক এক মাস পর ২০ মার্চ বিকেলে চুড়িহাট্টা গিয়েছিলাম। সেখান থেকে উর্দু রোড, চকবাজার, মৌলভীবাজার, মিটফোর্ড, বেচারাম দেউড়ির পথে পথে প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি। স্মরণকালের এই নির্মম দুর্ঘটনার পর গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যিক জনপদ কীভাবে নিজেকে পুনর্গঠিত করছে, সেটা বুঝতেই নানান পরিসরের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা হলো। হতবিহ্বল করা অবিশ্বাস্য শোকের স্মৃতি সবার মাঝেই জীবন্ত। অনিবার্যভাবেই আবারও ব্যস্ত পুরান ঢাকার হৃৎপিণ্ডতুল্য এই এলাকা। আলাপ-আলোচনায় বোঝা যায়—রাজনীতি ও প্রচারমাধ্যমের ওপর ক্ষুব্ধ স্থানীয় ব্যবসায়ীসমাজ। দুর্ঘটনা–পরবর্তী প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বোধ তাঁদের মধ্যে। আবার মতামত প্রকাশেরও পরিসর পাচ্ছেন না তাঁরা।

‘পুরান ঢাকা’ মানে অপরিকল্পনার ঐতিহাসিক–পরম্পরা মাত্র
ঢাকার একাংশই ‘পুরান ঢাকা’। সেই ঢাকাও এক অর্থে নতুন ঢাকার মতোই। পুরান ঢাকা নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভোগা অর্থহীন। সেখানে পুরোনো বাড়ি-ঘর-সংস্কৃতি কিছুই আর তেমন নেই। পুরোনো বাসিন্দারা অনেকেই বাড়িটা ভাড়া দিয়ে থাকেন নতুন ঢাকায়। সেসব বাড়িতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখন দোকান, ফ্যাক্টরি, গোডাউনের পাশাপাশি বাণিজ্যজগতের মানুষেরই বাস। এখানকার ট্রেডিংয়ের জগতে নোয়াখালী থেকে আসা মানুষের আধিক্য, ইসলামপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিক্রমপুরবাসী আর আলুবাজারের নাটবল্টু ব্যবসায়ীরা অনেকে কুমিল্লার। নতুন ঢাকার বাড্ডা, আদাবর কিংবা মগবাজার থেকে পুরান ঢাকা ব্যাপক ব্যতিক্রম কিছু নয়। ক্ষেত্রবিশেষে অধিকতর ঘিঞ্জি, অধিক দোকানপাট, ফ্যাক্টরিময় এলাকামাত্র। ইতিমধ্যে কামরাঙ্গীরচর আর কেরানীগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে ‘পুরান ঢাকা’। প্রতিমুহূর্তের নিবিড় অর্থনৈতিক সংগ্রামই সেখানকার মূল সংস্কৃতি। আবার এও সত্য, আগুন লাগলে নতুন ঢাকার লালমাটিয়ায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে পারবে—কিন্তু পুরান ঢাকার অনেক গলিতে সেটা আর সম্ভব নয়। এই ‘বাস্তবতা’ এখন আর বদলানো যাবে বলে মনে হয় না। অপরিকল্পনার ঐতিহাসিক–পরম্পরা এই নিয়তি তৈরি করেছে। মেঠো হাঁটাহাঁটিতে এ রকম আরও অনেক রূঢ়, নষ্ট ‘বাস্তবত’ যেকারও চোখে পড়বে সেখানে। তবে স্থানীয় মানুষ এসবে অভ্যস্ত এখন। নতুন ঢাকার চোখ দিয়ে পুরান ঢাকাকে দেখা তাই অর্থহীন।

২০ মার্চ চুড়িহাট্টা থেকে হাঁটতে হাঁটতে উর্দু রোড, চকবাজার, মৌলভীবাজার, মিটফোর্ড পেরিয়ে বেচারাম দেউড়িতে বসে দম নিতেই মনে পড়ল এই দীর্ঘ প্রাচীন পথজুড়ে কোনো ফুটপাত দেখিনি। রাস্তায় কোনো প্রাইভেট কারও ছিল না। এখানে কোনো ‘বাস লাইন’ও নেই। বিস্ময়করভাবে এসবের কোনো দাবিও নেই। সকাল-সন্ধ্যা মানুষ, রিকশা, ভ্যান আর ঠেলাগাড়িতে প্রায় অচল সড়কজুড়েই প্রতিক্ষণে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে। অনেক দোকানিই এখানে গাড়ির মালিক আছেন বা হতে পারেন। কিন্তু গলির ভেতর গাড়ি আনা তো দূরের বিষয়, হাঁটতেও অতি কষ্ট। পুরান ঢাকার এই বাস্তবতা নাটকীয়ভাবে বদলানো যাবে না আপাতত; বরং নতুন ঢাকার অনেক এলাকাও ক্রমে এ রকম হবে। অন্তত অনেকখানি হবেই। চলাচলের সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ গড়ার শেষ মুহূর্তটি হয়তো অনেক পেছনে ফেলে এসেছি আমরা। অতীত প্রজন্মের পাপের দায়ভার বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপরই বর্তায়। এটাই প্রতিবেশবিদ্যার নিয়ম।

প্রতিযোগিতা শক্তির সঙ্গে কথা বলতে হবে
প্রশাসনিক আটটি ‘থানা’ এবং জাতীয় সংসদের মাত্র তিন-চারটি আসন নিয়ে ‘পুরান ঢাকা’ গঠিত হলেও এর অর্থনৈতিক শক্তি অনেক অনেক বড় এবং বিস্তৃত। সারা দেশের সঙ্গে পুরান ঢাকার নিবিড় বাণিজ্যিক বন্ধন বিদ্যমান। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রায় ৪৫০টি বাণিজ্যিক ‘অ্যাসোসিয়েশন’ আছে এখানে। যদিও তার অনেকগুলোই এখন আর খোদ ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। এখানের বাসিন্দারা কেউ ‘ট্রেডার’, কেউ খুদে উদ্যোক্তা, কেউ আমদানিকারক। রয়েছে প্রচুর পরিবহন কোম্পানি। সারা দেশের খরিদ্দার আসছে। শ্যামবাজারের পাইকাররা সব চাটগাঁয়ের খাতুনগঞ্জের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসা করছে। বাবুবাজারের চাল ও ফল যাচ্ছে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত। এসব ঘিরেই গড়ে উঠেছে বিপুল শ্রমজীবীর আবাস, ব্যাংক-বিমা। সবাই এখানে একসূত্রে গাঁথা। সবাই পরস্পরের কাজে ‘মূল সংযোজন’ করে চলেছে। কাছাকাছি থাকাই এই পরিবারের মূল ব্যবসায়িক ‘সুবিধা’। এই সুবিধা ছাড়তে রাজি নন তাঁরা কেউই। আমদানিকারক এখানে যে জিনিস আমদানি করছেন, সেটাই ট্রেডার সরবরাহ করছে। সকাল-বিকেল সেটাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং তৈরি হয়ে বের হচ্ছে হরেক সামগ্রী। মোমবাতি থেকে স্বর্ণালংকার—কত শত পণ্য এখানে তৈরি ও বিক্রি হয় কেউ বলতে পারে না।

কেরানীগঞ্জে ছোট ছোট পোশাক কারখানার বিশাল যে গার্মেন্টপল্লির কথা আমরা জানি, তার উপাদানগুলোও নদীর এপার থেকেই যাচ্ছে। পুরান ঢাকা নিয়ে ভাবতে বসে উৎপাদনের এই শিকল বোঝা যেমন জরুরি, তেমনি এখানকার বিপণনের শিকলটিও গুরুত্বপূর্ণ। চকবাজারের একটি পাড়ায় কেবল গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয়—এমন ৫০টি সামগ্রী তৈরি হয়। এভাবে জীবনযাপনের জন্য জরুরি কত সামগ্রী কত কত ‘কারখানা’য় তৈরি হচ্ছে, তার কোনো শুমারি নেই। করাও দুরূহ। পাঁচ-দশ লাখ টাকার পুঁজিতেই গড়ে উঠেছে দুই–চারজন শ্রমিকের শত শত ‘কারখানা’। এমনও রয়েছে, যে পরিবার ‘মালিক’, তারাই ‘শ্রমিক’, তারাই ‘সরবরাহকারী’। যে বাড়িতে কারখানা, সেখানেই থাকার ঘর। হয়তো অনেকেরই প্রয়োজনীয় ‘ট্রেড লাইসেন্স’ নেই। হঠাৎ দেখলে লালবাগের ইসলামবাগ, কামালবাগ, শহীদনগরকে আবাসিক এলাকার চেয়ে প্লাস্টিক, পলিথিন আর প্রসাধনী সামগ্রীর শিল্পাঞ্চল বলেই মনে হয়। কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহন খরচ বাঁচিয়ে এবং গতরে খেটে এসব এলাকার ফ্যাক্টরি মালিকেরা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা গড়ে তুলেছেন কয়েক যুগের সাধনায়। যেকোনো হঠাৎ সৃষ্ট সংস্কারভাবনাকে রুটিরুজিতে আঘাত ভেবে ভয় পান এঁরা। এঁদের সঙ্গে কথা না বলে ‘পুরান’ ঢাকাকে ‘নতুন’ করে গড়ার চিন্তা তাই অর্থনৈতিক বিবেচনায় টেকসই নয়। যেকোনো নতুন অস্থিতিশীলতায় উৎপাদন খরচ বাড়লে বাজারের নিষ্ঠুরতায় হারিয়ে যেতে পারেন এঁরা। পথে বসবে তখন এঁদের সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ কাঁচামাল সরবরাহকারী ও পরিবহন ব্যবসায়ীরাও। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর রয়েছে অত্র অঞ্চলে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ।

‘তুলে দেওয়া’র সংস্কৃতি নয়, প্রয়োজন পুনর্বাসন
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর আপাত সংস্কারচিন্তার প্রধান টার্গেট ‘৩১ ধরনের কেমিক্যাল গুদাম’। এগুলোকে ‘বিপজ্জনক’ সাব্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু কার্যত এই এলাকায় ব্যবহৃত হয় শত শত ধরনের কেমিক্যাল। কোনটা তার দাহ্য আর কোনটা দাহ্য নয়—আমলাতান্ত্রিক পথে সেটা নির্ধারণ করে এই এলাকাকে নিরাপদ করা যাবে বলে মনে হয় না। পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে সঙ্গে নেওয়া জরুরি। কেউই এখানে ট্রেডিং ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানা সাম্রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন হতে দিতে চান না। অর্থাৎ পণ্য তৈরির কাঁচামাল, পণ্য তৈরির কারখানা, পণ্যের শোরুম এবং পণ্য পরিবহনের নিবিড় বন্ধনটিকে কাছাকাছি রাখা না হলে পুরান ঢাকার অর্থনৈতিক শক্তি বাঁচবে না। ‘নিরাপত্তা’র ভাবনাটি বাস্তবায়ন করতে হবে তাই সবাইকে একসূত্রে গেঁথে। কাউকে পোস্তগোলা আর কাউকে কেরানীগঞ্জ পাঠালে এখানকার উৎপাদন–শিকলটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এই জনপদের অবকাঠামোগত সংস্কার চিন্তায় স্থানীয় সমাজের আকাঙ্ক্ষার এই দিক বিবেচনায় না নিলে কোনো উদ্যোগ দীর্ঘ মেয়াদে সফল হবে বলেও মনে হয় না। তখন স্রেফ কিছু ব্যবসায়ী কিছুদিনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে, প্রচুর মানুষ বেকার হবে—আর কিছু ব্যাংকের লগ্নি খেলাপি হবে মাত্র।

যদিও এখনো বসবাসকারী প্রচুর নাগরিক আছে গেন্ডারিয়া থেকে হাজারিবাগ পর্যন্ত—কিন্তু এই সমগ্র জনপদের প্রধান বৈশিষ্ট্য বাণিজ্যিক। ফলে এখানে যেকোনো অবকাঠামোগত সংস্কারচিন্তায় ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা-সংলাপ জরুরি। ‘বিপজ্জনক’ কেমিক্যাল সরাতে তাঁরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত—তবে ‘তুলে দেওয়া’র সংস্কৃতির বদলে সঠিক পুনর্বাসন–পরিকল্পনা দেখতে অপেক্ষায় আছেন তাঁরা। সে ক্ষেত্রে কেবল ‘কেমিক্যালপল্লি’ নয়—পাশাপাশি পুরান ঢাকার খুদে উৎপাদক এবং ট্রেডারদের কথাও ভাবতে হবে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক