মরণসাগরপারে ভাওয়াইয়ার 'রাজা'

রাজার মৃত্যুতে ভাওয়াইয়া গানের ক্ষতি হলো; কিন্তু যত দুঃখ পেয়ে মারা গেলেন তার কী হবে?
রাজার মৃত্যুতে ভাওয়াইয়া গানের ক্ষতি হলো; কিন্তু যত দুঃখ পেয়ে মারা গেলেন তার কী হবে?

ভাওয়াইয়াশিল্পী সফিউল আলম রাজা ভাইয়ের সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না, মুঠোফানে কথা হবে না। তাঁর কণ্ঠে হাজার দর্শক মুগ্ধ হবে না। টেলিভিশনে পছন্দের গানের জন্য অসংখ্য ভক্তের অনুরোধ আসবে না। তাঁকে আর কেউ ‘ভাওয়াইয়ার রাজা’, ‘ভাওয়াইয়ার রাজকুমার’, ‘ভাওয়াইয়ার ফেরিওয়ালা’ সম্বোধন করে ডাকবে না। জন্মস্থান কুড়িগ্রামের চিলমারীতে শান্তিনিকেতনের মতো একটি সংগীতবিষয়ক প্রতিষ্ঠান করার স্বপ্ন ছিল। তা-ও হবে না। রাজা ভাই খুব অসময়ে, অকালে চলে গেলেন। চলতি সময়ে ভাওয়াইয়া গান দেশে-বিদেশে অনন্য একপর্যায়ে যাঁরা উন্নীত করছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন সফিউল আলম রাজা। ৪৮ বছর চলে যাওয়ার পক্ষে খুবই অল্প সময় রাজা ভাই, খুব অল্প সময়।

১৭ মার্চ না-ফেরার দেশে চলে গেলেন রাজা ভাই। তারপরও বলব, তিনি মারা যাননি। ‘মরণসাগরপারে’ তিনি অমর। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে নিজের লেখা একটি গান প্রসঙ্গে রাজা ভাই বলেছেন, ‘দোতরার কান্নাও বুঝতে পারে মানুষ, সারিন্দার কান্নাও বোঝে। কিন্তু আমার যে একটা কান্না আছে, সেটি কে বুঝবে?’ আমরা জানি না, কী কষ্ট ছিল তাঁর। তবে এটুকু জানতে পারি, তিনি ভীষণ এক প্রতিকূল জীবনের যাত্রী ছিলেন। নাম-যশ-খ্যাতি কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। তাঁর নামে কোনো অপবাদও ছিল না। তিনি সংগীতের জন্য জীবনের প্রায় সবটুকু সময়ই নিয়োজিত রেখেছিলেন। অথচ সংগীত পরিবেশনের বিনিময়ে যে সম্মানী পেতেন, তা জীবনযাপনের জন্য খুবই সামান্য।

ভীষণ অর্থকষ্টে দিন যাপন করছিলেন। এই কষ্ট তাঁকে মানসিক চাপে রেখেছিল। একটি জাতীয় দৈনিকে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। কর্তৃপক্ষ প্রাপ্য পরিশোধ না করেই তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছিল। সাংবাদিক জীবনে তিনি সততা থেকে কখনো চ্যুত হননি। সাংবাদিতায় বড় বড় অনেক পুরস্কার পেলেও যে দৈনিক পত্রিকায় কাজ করতেন, সেখানকার প্রায় ২৩ লাখ টাকা তিনি পাননি। টাকা পাওয়ার জন্য একটি মামলা করেছেন। সেই মামলা চলেই আর তাঁর কী লাভ। তিনি এখন এসব লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে। এই টাকা পেলে এত বড় মাপের একজন গুণী শিল্পীকে আমরা হয়তো অকালে হারাতাম না। আমাদের এক বন্ধু নাহিদ হাসান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মালিকের কাছে পাওনা ২৩ লক্ষ টাকা পেলে তিনি কি মারা যেতেন?’ বছর দেড়েক আগে অনলাইনভিত্তিক একটি গণমাধ্যমে বার্তাপ্রধান হিসেবে যোগদান করেছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সেখান থেকেও তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। রাজা ভাই এখন এমন এক জগতের বাসিন্দা হলেন, সেখানে আর কেউ তাঁকে অব্যাহতি দিতে পারবে না।

রাজা ভাই সংগীতের এটি স্কুল খুলেছিলেন। এই স্কুলে লোকসান করলেও হাল ছাড়েননি। চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। ‘ভাওয়াইয়া’ নামের একটি গানের দল করেছিলেন। তাঁর চেষ্টা কেবলই পালক মেলতে শুরু করেছিল, সেটি থেমে গেল।

গুরুর প্রতি ভক্তি কেমন থাকতে হয়, তা শিখিয়েছেন সফিউল আলম রাজা। তাঁর গুরু ছিলেন প্রখ্যাত ভাওয়াইয়াশিল্পী ও গীতিকার নুরুল ইসলাম জাহিদ। যখন নুরুল ইসলাম জাহিদ অসুস্থ হন, তখন কতভাবে গানের অনুষ্ঠান করে অর্থের সংস্থান করেছেন তিনি। গুরুর প্রতি তাঁর যে গভীর ভক্তি প্রদর্শন, তা আজকাল আর দেখা যায় না। আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজা ভাইয়ের গুরুভক্তিতে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

সফিউল আলম রাজার গানের ভক্ত ছিল প্রচুর। তাঁর কণ্ঠে যেন গান খেলা করত। আমার বন্ধু-সহকর্মী শাহীনুর রহমান একদিন আমাকে বলছিল, ‘রাজা ভাইয়ের গান টিভিতে শুরু হলে আমি আর কোনো চ্যানেল চেঞ্জ করি না। যতক্ষণ রাজা ভাই গান করেন, ততক্ষণ আমি শুনি।’ আরেক দিন কুড়িগ্রামে সফি ভাই, আমি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক জয়নুল আবেদীন আড্ডা দিচ্ছিলাম। জয়নুল বলছিলেন, ‘রাজা নামের একজন শিল্পী অসম্ভব সুন্দর ভাওয়াইয়া গান করেন। তাঁর অনেক গান ডাউনলোড করে মোবাইলে রেখেছি। আমি সব সময় শুনি।’ সফি ভাই তখনই রাজা ভাইকে ফোন দিয়ে জয়নুলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন।

ভাওয়াইয়া গানের বিখ্যাত শিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মা বলেন, ‘ভাওয়াইয়া গানের প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকায় আমাদের রাজা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে ভাওয়াইয়া গানের একটি বড় খুঁটি চলে গেল। শুধু ভাওয়াইয়ারই শিল্পী ছিলেন তিনি। তিনি ভাওয়াইয়া গানকে টেলিভিশনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার চেয়ে বেশিসংখ্যক ভাওয়াইয়া কেউ টেলিভিশনে গাইতে পারেননি।’ তিনি বাংলাদেশ বেতারের বিশেষ শ্রেণিভুক্ত এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম শ্রেণির শিল্পী ছিলেন। দেশে-বিদেশে অসংখ্য মঞ্চে এবং টেলিভিশনে ভাওয়াইয়া গান গেয়েছেন।

রাজা ভাই ২৮ ডিসেম্বর একটি গানের কথা দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘চাঁদনী রাইতে নদীর ঘাটে/ চলে সুখের তরি/ কিবা চাইলাম-কিযে হইল/ জীবন যায় ছাড়ি।’ রাজা ভাই কতখানি সুখে ছিলেন জানি না, তবে তার জীবন গেছে ছেড়ে।

সফিউল আলম রাজা ৪৮ বছরের জীবদ্দশায় অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। সাংবাদিকতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার, ডেমোক্রেসি ওয়াচ হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড, ইউনেসকো ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক সম্মাননায় ভূষিত হন। তিনি ২০০৬ সালে শ্রেষ্ঠ ভাওয়াইয়াশিল্পী হিসেবে বিজয়ী হন।

বাংলাদেশের সব টেলিভিশনে তিনি নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করতেন। নিজে ভাওয়াইয়া গান লিখেছেন, সুর করেছেন, কণ্ঠ দিয়েছেন। একাধারে গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষক। পাহাড়সমান কষ্ট চাপা দিয়ে তিনি গানেই জীবনের সুখ সন্ধান করেছেন। মারা যাওয়ার আগের দিন ডাক্তার তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন হার্টের চিকিৎসার। ওই দিন রাতে টেলিভিশনে সংগীত অনুষ্ঠান ছিল। তাই এক দিন পর চিকিৎসা নেবেন বলেছিলেন। রাতে গান গেয়ে এসে ঘুমিয়েছেন, আর ওঠেননি। ওই তাঁর শেষ গান, ওই তাঁর শেষ ঘুম।

মানুষের মুখে মুখে, গানে গানে রাজা ভাই বহুকাল, বহুবার উচ্চারিত হবেন। এখানেই তার বেঁচে থাকা। বস্তুত শিল্পীরা কখনো মারা যান না।

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]