শ্বেত জাতীয়তাবাদ ঠেকাব কীভাবে

শ্বেত জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে বিক্ষোভ
শ্বেত জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে বিক্ষোভ

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড যত অভাবনীয়ই মনে হোক না কেন, এমন ঘটনা শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল।

গত চার দশকে পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানসহ সব বহিরাগত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা জমে উঠেছে। শ্বেতসভ্যতার অনুসারীদের বিশ্বাস, কালো, বাদামি ও হলুদ রঙের এই মানুষগুলো সাদা মানুষদের দেশে এসে ভিড় জমিয়েছে, আর তার ফলে তাদের শ্বেতসভ্যতা হুমকির সম্মুখীন। এই শ্বেতসভ্যতার দুটি খুঁটি: মানুষগুলো সব সাদা, আর তাদের বিশ্বাস খ্রিষ্টধর্মে। সে মনে করে অন্য সবার চেয়ে সে শ্রেষ্ঠ, একে টিকিয়ে রাখতে হলে বাকি সবাইকে তাড়াতে হবে। অশ্বেতাঙ্গ যারা ইতিমধ্যে এসে পড়েছে, তাদের ঝেঁটিয়ে তাড়ানো অসম্ভব হলে নিদেনপক্ষে তাদের নতুন করে আসা ঠেকাতে হবে।

একসময় যুক্তরাষ্ট্রে কু ক্লাক্স ক্ল্যান (কেকেকে) নামের একটি গোষ্ঠীকে ভাবা হতো এই শ্বেত জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রবক্তা। যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার অবসান ও অপেক্ষাকৃত উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আসন গেড়ে নেওয়ার পর থেকে কেকেকে মূলধারার বাইরে একটি প্রান্তিক আন্দোলন বলে মনে করা হয়। কিন্তু কেকেকে নামে না হলেও শ্বেত জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী লোকের অভাব কোনোকালেই ছিল না। তাদের একাংশ বরাবরই ভেবে এসেছে, বাকি সবার ওপর ছড়ি ঘোরানো তাদের ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার। শ্বেত বর্ণ, শ্রেষ্ঠত্ব ও খ্রিষ্টধর্মের দোহাই দিয়ে হিটলার ৬০ লাখ ইহুদিকে পুড়িয়ে মেরেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই, এ–ও একধরনের মৌলবাদ, যা সব যুক্তি ও মানবিক মূল্যবোধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়।

সাদারা যত দিন ক্ষমতায় বসে ছড়ি ঘুরিয়েছে, তত দিন কোনো দুশ্চিন্তার কারণ দেখেনি। সমস্যা বাধল যখন কালো, হলুদ ও বাদামি মানুষগুলো স্বাধীন হওয়া শুরু করল। শুধু স্বাধীনই নয়, নিজেদের সাদাদের সমান ভাবা শুরু করল। বিপদ সেখানেই শেষ নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অভিবাসনপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এরা ইউরোপ ও আমেরিকায় দল বেঁধে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আসতে লাগল। পশ্চিমা অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য শ্রমিক হিসেবেই তাদের আনা হয়েছিল। কিন্তু সংখ্যায় ক্রমে বাড়তে থাকায় হঠাৎ সাদাদের খেয়াল হলো, এদের না ঠেকালে একসময় এরা তো সংখ্যায় আমাদের চেয়েও ছাড়িয়ে যাবে। শুরু হলো উল্টো প্রতিক্রিয়া: যেভাবে পারো অভিবাসন ঠেকাও।

শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদের নয়া প্রবক্তাদের অন্যতম প্যাট বুকানন। আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির নামজাদা নেতা, একসময় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি ২০০১ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্য ডেথ অব দ্য ওয়েস্ট গ্রন্থে লিখেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব এখন আক্রান্ত, অভিবাসীদের ‘আগ্রাসনের’ কারণে পশ্চিমা সভ্যতা মরতে বসেছে। এই ‘আগ্রাসন’ ঠেকানো না গেলে ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের দেশে পরিণত হবে। তিনি আমেরিকার সাদা মানুষদের জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অভিবাসীদের ‘আগ্রাসনের’ কথা বলে বুকানন তিনবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টা করে পারেননি। ২০১৬ সালে সেই ‘আগ্রাসনের’ কথা বলেই নির্বাচনে লড়ে আমেরিকার ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন আরেক সাদা মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্প।

শুধু আমেরিকায় নয়, ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই এখন এই শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদ জেঁকে বসেছে। হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, সুইডেনে ‘সাদা বাঁচাও’ স্লোগান তুলে অতি-দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতা দখল করছে। অভিবাসন ঠেকানোর যুক্তিতে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। হাঙ্গেরির ভিক্তর ওরবানের প্রধান স্লোগান হলো অভিবাসন ঠেকাও, নইলে নিজেরা মরবে। যদি ভেবে থাকো অভিবাসন অব্যাহত রেখে বাঁচতে পারবে, তাহলে সেটা ভুল। ওরবানের এই কথাকে শ্বেত জাতীয়তাবাদীরা অভ্রান্ত বলে বিবেচনা করে। আমেরিকার সবচেয়ে পরিচিত শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী প্যাট রামসি বলেছেন, ওরবান ‘পশ্চিমা সভ্যতার একজন নায়ক’।

শ্বেত জাতীয়তাবাদীদের চোখে ডোনাল্ড ট্রাম্পও ‘পশ্চিমা সভ্যতার একজন নায়ক’। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের সময় ঘোষণা করেছিলেন, ‘আজ থেকে এই দেশে আমরা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত হব। এখন থেকে সব ব্যাপারেই শুধু আমেরিকা প্রথম—এটাই হবে আমাদের নীতি।’ ট্রাম্প আসলে কী বলছেন, কার উদ্দেশে বলছেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্লেইট পত্রিকার জামিল বুয়ি লিখেছিলেন, এখন থেকে হিসাবের মধ্যে থাকবে আমেরিকা, আর যেসব আমেরিকান এই হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে, তারা সবাই সাদা।

দুই বছর আগে ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে কেকেকের বর্ণবাদী হামলার সমর্থনে ট্রাম্প বলেছিলেন, এদের মধ্যেও অনেক ভালো মানুষ আছে। সে কথা উল্লেখ করে আমেরিকার প্রধান বর্ণবাদী ওয়েবসাইট ডেইলি স্টর্মার মন্তব্য করেছিল, ‘ট্রাম্প আমাদের ব্যাপারে একটি মন্দ কথাও বলেনি। ঈশ্বর তাঁর কল্যাণ করুন।’ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের সেই ঘাতকও কোনো দ্বিধা ছাড়াই ট্রাম্পকে ‘শ্বেত জাতীয়তাবাদের নবায়িত আত্মপরিচয়ের প্রতীক’ হিসেবে বাহবা দিয়েছেন।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমরা শ্বেত জাতীয়তাবাদের বিপদকে দু-একটি দেশের ‘অল্প কিছু মানুষের কাণ্ড’ বলে ভাবতাম। ট্রাম্পও সে কথাই বলেছেন। কিন্তু ইন্টারনেটের এই যুগে মানুষে মানুষে সীমান্ত চিহ্ন উঠে গেছে। একাকী একজন মানুষও ইন্টারনেটের কারণে এক বিশাল ‘সম্প্রদায়ের’ অংশ হিসেবে নিজেকে ভাবতে পারে। ক্রাইস্টচার্চের ঘাতক যুবকটি ঠিক এই কারণেই পুরো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ফেসবুকে সরাসরি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। লাখ লাখ মানুষ সেই ভিডিও দেখেছে, উৎফুল্ল মন্তব্য করেছে।

কোনো সন্দেহ নেই, অব্যাহত অভিবাসন প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শ্বেত জাতীয়তাবাদী তৎপরতা বাড়বে। একজন ব্যক্তি হোক বা সংগঠিত কোনো গ্রুপই হোক, ক্রাইস্টচার্চের মতো ঘটনা শুধু ‘প্রার্থনা ও শুভকামনা’ জানিয়ে থামানো যাবে না। যেমন থামানো যাচ্ছে না জঙ্গিবাদকে। এই দুইয়ের মতো অন্তর্গত মিল অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই কারণে তাদের ঠেকাতেও আমাদের অভিন্ন রণকৌশল অবলম্বন করতে হবে।

প্রথমত, প্রতিবাদ করতে হবে। কোনো ধরনের মৌলবাদকেই মূলধারাভুক্ত হতে দেওয়া যাবে না। শ্বেত জাতীয়তাবাদী বক্তব্য একবার ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে গৃহীত হলে তা জাতীয় আলোচনার অংশ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঠিক এভাবেই হাঙ্গেরিতে ওরবানের মতো শ্বেত মৌলবাদী ক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, শ্বেত জাতীয়তাবাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু অভিবাসী সম্প্রদায়। তাদেরও এই প্রতিবাদপ্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠতে হবে। একা নয়, মূলধারাভুক্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে। যত দিন অভিবাসীরা বহিরাগত থেকে যাবেন, তত দিন তাঁরা শ্বেত জাতীয়তাবাদের সহজ ‘টার্গেট’ই হয়ে থাকবেন।

তৃতীয়ত, শ্বেত জাতীয়তাবাদের বিস্তারের একটি প্রধান মাধ্যম ইন্টারনেট। অভিবাসী ও ভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ছড়ানো হয় এই নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমেই। ফেসবুক ও গুগলের মতো প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলোকে আরও সচেতন হতে হবে, যাতে এদের মাধ্যমে শ্বেত জাতীয়তাবাদী ঘৃণা ছড়ানো সম্ভব না হয়। তারা হয়তো নিজে থেকে এই কাজ করবে না। আমরা যারা ভোক্তা, তাদের সে কাজে বাধ্য করতে পারি।

শেষ কথা, শুধু শ্বেত জাতীয়তাবাদকে আক্রমণ করে এই সংকটের সমাধান সম্ভব হবে না। যতই অনিষ্টকর হোক, এই বর্ণবাদী আন্দোলনের একটি কল্পিত ভিত্তি রয়েছে। অভিবাসন নিয়ে পশ্চিমের সাদা মানুষদের একধরনের ভীতি গ্রাস করেছে, যেই ভীতিকে ব্যবহার করে ট্রাম্প ও ওরবানের মতো রাজনীতিক ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এসেছেন। এই ভীতির কারণ বুঝতে হবে, তা মিথ্যা সে কথা প্রমাণ করতে হবে। তা প্রমাণের দায়িত্ব শ্বেত জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে এমন সব মানুষের। অভিবাসীদেরও এই বিপক্ষ তালিকায় কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি