প্রবৃদ্ধির বিভ্রম বনাম সুখ

বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের একটি। গত জানুয়ারি মাসেই জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ (ইউএনডেসা) এই তথ্য বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছে। চলতি অর্থবছরের জন্য সরকারের প্রাক্কলন ছিল, প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। জাতিসংঘের হিসাবে তা ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে এখন সরকার বলছে, প্রবৃদ্ধি হবে আরও বেশি, ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ১৯ মার্চ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভা শেষে সাংবাদিকদের বললেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে যে হিসাব করেছে, তার ভিত্তিতেই তিনি এই হার অনুমান করছেন। এই হার অর্জিত হলে এটাই হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি।

নিঃসন্দেহে ভালো খবর। কিন্তু সমস্যা করেছে জাতিসংঘেরই আরেকটি সংস্থার অন্য একটি প্রতিবেদন। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার ঠিক এক দিন পরেই জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক ‘বৈশ্বিক সুখ প্রতিবেদন ২০১৯’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হলো, বিশ্বের সুখী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ গত এক বছরে ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে। ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১২৫তম। মূলত দুর্নীতি, মাথাপিছু জিডিপি, সামাজিক সহায়তা, স্বাধীনতা, উদারতা ও প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালের ভিত্তিতে সুখী দেশের তালিকাটি করা হয়েছে।

তাহলে কি জিডিপির সঙ্গে সুখের সম্পর্কটি অনেক গোলমেলে। আসলে জিডিপি ব্যাপারটির মধ্যেই একটা গোলমাল আছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকেই উন্নয়ন মনে করা হতো। বলা হতো, প্রবৃদ্ধির সুফল গড়িয়ে ওপর থেকে নিচের দিকের মানুষের কাছে যাবে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষেরও আয় বাড়বে। অর্থনীতির ভাষায় একে বলা যায় ‘ট্রিকল ডাউন থিওরি’। তবে উন্নয়নের এই ধারণা সত্তরের দশকেই পরিত্যাগ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। কারণ, প্রবৃদ্ধি বাড়লেও আয়বৈষম্য বাড়ে তার চেয়ে বেশি।

তবে উন্নয়ন অর্থনীতিবিদেরা পরিত্যাগ করলেও অনেক রাষ্ট্র কিন্তু এখনো জিডিপি প্রবৃদ্ধি খুবই ভালোবাসে। এর পেছনে এমন কিছু কারণ আছে, যা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেমন প্রবৃদ্ধি বাড়লে একটি দেশের ভাবমূর্তি ভালো বলে মনে করা হয়, বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, এর একধরনের রাজনৈতিক মূল্য আছে। সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। তবে কোনো
কোনো রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা এতটাই প্রবল যে তারা যেনতেনভাবে জিডিপি বাড়াতে চেষ্টা করে, এমনকি পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে জিডিপি বেশিও দেখায়।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পাশের দেশ থেকে ঘুরে আসা যাক। কেননা, প্রবৃদ্ধি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা গেছে ভারতেই। সেখানে নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। বর্তমানের বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকারের আগে পরপর দুই দফায় ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকার। ওই দুই দফায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৪। মোদি সরকারের সময়ে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে হঠাৎ করেই মোদি সরকারের গঠন করা একটি কমিটি বিগত প্রায় ১৫ বছরের জিডিপির একটি সংশোধিত হিসাব প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, ইউপিএ সরকারের সময়ে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল আসলে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, আর এনডিএ সরকারের সময় প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।

স্বাভাবিকভাবেই জিডিপির এই সংশোধন নানা ধরনের মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর শিরোনাম ছিল ‘মোদির অধীনে ভারত বেশি ভালো করেছে, যদি আপনি জিডিপি বিশ্বাস করেন’। আর সমালোচকেরা বলছেন, এই পরিসংখ্যান একান্তই নরেন্দ্র মোদির।

এই যে যেকোনোভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো, একেই ডেভিড পিলিং বলেছেন ‘প্রবৃদ্ধির বিভ্রম’। ডেভিড পিলিং একজন মার্কিন সাংবাদিক। গত বছর একটি বই লিখে মোটামুটি সাড়া ফেলে দিয়েছেন। বইটির নামই হচ্ছে দ্য গ্রোথ ডিলিউশন, যাকে বাংলায় বলা যায় ‘প্রবৃদ্ধির বিভ্রম’। সেখানে তিনি উদাহরণ দিয়েছেন, আপনি যদি এটি গাড়ি চুরি করে বিক্রি করে দেন, তাহলে তা প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে, কিন্তু একজন বয়স্ক দুস্থ মানুষ বা তিনজন পথশিশুকে আশ্রয় দেন, তাহলে এর কোনো প্রভাবই জিডিপিতে পড়বে না।

দুই অর্থনীতিবিদের সেই গল্পও বলা যায়। দুজন হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন, একটু দূরে অদ্ভুত কিছু বস্তু পড়ে আছে। কিছুক্ষণ গবেষণা করেও চিনতে পারলেন না তাঁরা। এক অর্থনীতিবিদ বললেন, তুমি যদি ওটা খেতে পারো, তাহলে এক হাজার পুরস্কার পাবে। অন্যজন রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু খেয়ে বুঝলেন, বস্তুটি নিতান্তই অখাদ্য। কিন্তু একাই খাবেন কেন। এবার অপর অর্থনীতিবিদকে বললেন, এবার তুমি যদি খেতে পারো, তাহলে তুমিও পাবে এক হাজার টাকা। খেলেন তিনিও। এবার দুজনেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। তবে অর্থনীতিবিদ তো, দুজনে এক হাজার টাকা করে পকেটে পুরে বললেন, খারাপ লাগছে তাতে কী, অসুস্থ মনে হচ্ছে তাতেও-বা কী, এই যে দুই হাজার টাকা হাতবদল হলো, অর্থনীতিতে যুক্ত হলো, এতে দেশের জিডিপি তো বাড়বে।

প্রবৃদ্ধির এই বিভ্রম একটি দেশকেও আসলে অসুস্থ করে তোলে। প্রশ্ন দেখা যায় বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও। বাংলাদেশের কথাই ধরি। ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির আশা করলেও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সমন্বয় করলে হিসাব মেলাতে পারছেন না কেউ। ব্যাংকঋণের প্রবাহ কম, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কম, কর্মসংস্থানও কম—তারপরও জিডিপি কী করে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, সে প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন।

আবার এই যে ১০ বছর ধরে গড় প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি, দেশ ও দেশের মানুষের ওপর এর প্রভাব কতটা, সে প্রশ্নও রয়েছে। প্রথমেই আসা যাক বৈষম্য প্রশ্নে। জিডিপির প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ যে বৈষম্য তৈরি করে, বিশ্বে এর বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। অর্থনীতি শাস্ত্রে আয়ের বৈষম্য পরিমাপ করা হয় জিনি বা গিনি সহগের মাধ্যমে। এখানে সর্বশেষ খানা ব্যয় ও আয় জরিপ করা হয় ২০১৬ সালে। সর্বশেষ হিসাবে এখানে জিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৮৩। সাধারণত জিনি সহগ শূন্য দশমিক ৫ পেরিয়ে গেলে তাকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ বলা হয়। বাংলাদেশ দশমিক ৫-এর খুবই কাছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ। আর এই যদি হয় আয়বৈষম্যের হাল, তাহলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে এত বড় বড় কথা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তারপরও তো কাটে না প্রবৃদ্ধির বিভ্রম।

মার্কিন সাংবাদিক ডেভিড পিলিংয়ের কাছে আবার ফিরে যাই। বইটি প্রকাশের পরে ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪০ বছর ধরে প্রবৃদ্ধির বড় অংশের ভাগ বা সুফল পেয়েছে শীর্ষ আয়ের দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। আর তারা হচ্ছে সেই দশমিক ১ শতাংশ মানুষ, যারা রাজনীতিবিদদের অর্থায়ন করে, তারাই অর্থনীতির অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করে দেয়।’

তাহলে প্রবৃদ্ধির কি কোনো উপকারই নেই? রিচার্ড ইস্টারলিন একজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ। ১৯৭৪ সালে প্রবৃদ্ধি আর সুখের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে তিনি যে তত্ত্বটি দিয়েছিলেন, তাকে বলা হয় ‘দ্য ইস্টারলিন প্যারাডক্স’। তিনি দেখিয়েছেন, প্রবৃদ্ধি বাড়লে সুখ বা সন্তোষও বাড়ে, তবে একটা পর্যায়ে যাওয়ার পরে ঘটনা উল্টে যায়। তখন প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ে, সেই হারে আর সুখ বাড়ে না। তবে এখনকার পরিস্থিতি আরও খারাপ। যেমন প্রখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট চলতি সংখ্যায় ১২৫টি দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, বিশ্বে এমন ৪৩টি দেশ আছে, যাদের আয় বাড়লেও সুখ কমেছে। বাংলাদেশই তো এর বড় উদাহরণ। জিডিপি বেড়েছে, সুখের সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে।

এই অবস্থায় ডেভিড পিলিং একটি দেশকে কেবল জিডিপির পেছনে না দৌড়ে, কীভাবে ভালো থাকতে হয়, সেদিকে নজর দিতে বলেছেন। তাঁর সংজ্ঞায় ভালো থাকার অর্থ হচ্ছে সুস্থ থেকে আয়ুষ্কাল বাড়ানো, যূথবদ্ধ হয়ে থাকার মনোভাব, অপরাধের স্বল্প হার, নির্মল বায়ু ও বিশুদ্ধ পানি এবং নিজের জীবন নিয়ে ভালো একটা মনোভাব।

কিন্তু আমরা কী করছি। জীবন সম্পর্কে আমাদের মনোভাবটাই-বা কী। আসলে আমরা বৈষম্য বাড়াচ্ছি, বন ধ্বংস হচ্ছে, আমাদের নদীগুলো দূষিত, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার আমরা, কৃষিজমি কমছে, উন্নয়ন প্রকল্পের চাপে ভূমি হারাচ্ছে গরিব মানুষ, আইনের শাসন কাজ করে না, বাক্‌স্বাধীনতা সংকুচিত, আছে গুম-খুনের ভয়, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আছে অসন্তোষ, গণপরিবহনে চলে চরম নৈরাজ্য, কাজ পেতে দিতে হয় ঘুষ। অথচ আমাদের জিডিপি বাড়ছে।

পল হওকেন মার্কিন পরিবেশবিদ। তিনি বাংলাদেশ নিয়ে বলেননি ঠিকই, কিন্তু অনায়াসে এখানে তাঁকে ব্যবহার করতে পারি। তিনি বলেছিলেন, ‘এখন আমরা ভবিষ্যৎকে চুরি করে বর্তমানের কাছে বিক্রি করছি। আর এরই নাম দিয়েছি জিডিপি।’

শওকত হোসেন প্রথম আলোর প্রধান বার্তা সম্পাদক