আমরা যেখান থেকে শিখতে পারি

জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সূচক এক দশক ধরে সন্দেহাতীতভাবে জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশ অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে। কিন্তু যে বিপদটি এ দেশের ১৯৭৫-পরবর্তী শাসক মহল তাদের ভ্রান্ত অর্থনৈতিক দর্শন ও উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে ডেকে আনছে তা হলো, আশির দশক থেকেই আয়বৈষম্য ক্রমে বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোনো অর্থনীতির জিনি (বা গিনি) সহগ যখন বেড়ে ০.৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তখন নীতিনির্ধারকদের বোঝার কথা, আয়বৈষম্য বিপজ্জনক স্তরে চলে যাচ্ছে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩৬, মানে প্রচণ্ড দারিদ্র্যকবলিত দেশ হলেও তখন এ দেশে আয়বৈষম্য তুলনামূলকভাবে সহনীয় ছিল। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশকে জিনি সহগ বেড়ে ২০০০ সালে ০.৪৫-এ পৌঁছে যায়। ২০১৬ সালে তা বেড়ে ০.৪৮৩-এ পৌঁছে গেছে। আরেকটি পরিমাপেও ২০১০ ও ২০১৬ সালের মধ্যে আয়বৈষম্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে এবং ৫-১০ শতাংশ ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি ফুটে উঠেছে। ২০১০ সালে দরিদ্রতম ৫ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল জিডিপির ০.৭৮ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে মাত্র ০.২৩ শতাংশে নেমে গেছে। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, দেশের ধনাঢ্য ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর দখলে ২০১০ সালে ছিল জিডিপির ৩৫.৮৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে। আরও দুঃখজনক, জনগণের সবচেয়ে ধনাঢ্য ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর দখলে ২০১৬ সালে চলে গেছে জিডিপির ২৭.৮৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪.৬১ শতাংশ।

বাংলাদেশের গত ৪৩ বছরের ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ ফসল এই ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ এক্সের সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক, ২০১২ সাল থেকে ২০১৭—এই পাঁচ বছরে ধনকুবেরের সংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারে বিশ্বে ১ নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই এই বাংলাদেশ চাননি। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১০ সালের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে আবার সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের আট বছর পর ২০১৯ সালের বাংলাদেশে এখনো ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ এবং ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র দোর্দণ্ড প্রতাপই চলছে।

সমাজতন্ত্র কোথায়? সমাজতন্ত্র বলতে আমরা নিশ্চয়ই অধুনালুপ্ত সোভিয়েত স্টাইলের ‘স্টেটিজম’ প্রতিষ্ঠার আবদার করছি না, ওই প্রত্যাখ্যাত মডেলগুলোকে বিশ্বের কোনো দেশে আর ফেরত আনা যাবে না। কিন্তু বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের নানাবিধ পরিবর্তিত প্রায়োগিক মডেল, যেগুলোকে একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখায় চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করতে দেখছি, সেগুলো থেকে আমরা শিক্ষা নিচ্ছি না কেন? যেমন, ‘দোই মোই’ বা নবায়ন (renovation) কার্যক্রমে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম কোন পথে এগোচ্ছে, দেখতে অসুবিধা কোথায়? বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তিনি বাংলাদেশে সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতান্ত্রিক মডেল প্রয়োগের পদক্ষেপ নেননি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন।

১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন বাহিনী পরাজিত হয়ে পালিয়েছিল। যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভিয়েতনামকে মার্কিনিরা অর্থনৈতিক অবরোধের শিকার করেছিল আরও ১২ বছর। এতত্সত্ত্বেও ভিয়েতনাম কোনো দেশের কাছে ভিক্ষার জন্য হাত পাতেনি, এমনকি জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতেও আবেদন করেনি। অথচ তখন কী দারুণ কষ্টকর ছিল ভিয়েতনামের জনগণের জীবন! ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ৬৫ ডলার, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ জাতির সাড়ে চার দশকের সাধনার পর উইকিপিডিয়া দেখাচ্ছে, ২০১৯ সালে ওই মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৭৮৮ ডলারে পৌঁছে গেছে (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি ভিত্তিতে ৮ হাজার ৫৯ পিপিপি ডলার), যেটাকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ‘মিরাকল’ আখ্যায়িত করেছে। বর্তমানে ভিয়েতনামের মাত্র ৮.২ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এই ‘মিরাকল’-এর পেছনের কাহিনি কী? ভিয়েতনামের রাষ্ট্রনেতারা এখনো তাঁদের রাষ্ট্রকে ‘সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম’ অভিহিত করেন, কিন্তু ১৯৮৬ সালে ‘দোই মোই’ বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার ৩৩ বছর পর ভিয়েতনামের অর্থনীতিকে ‘সোশ্যালিস্ট-ওরিয়েন্টেড মার্কেট ইকোনমি’ অভিহিত করা হচ্ছে।

‘দোই মোই’-এর প্রধান তিনটি ডাইমেনশন: ১. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উদারীকরণ, ২. অর্থনীতির বি-নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি হস্তক্ষেপ হ্রাস এবং ৩. রাষ্ট্রীয় খাতের বিনিয়োগ জোরদার করার মাধ্যমে শিক্ষা ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রথম অগ্রাধিকার প্রদান। বিশেষত, প্রাইমারি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভিয়েতনাম ২০০০ সালের মধ্যেই পুরো জনসংখ্যাকে শতভাগ শিক্ষিত করেছে এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সফল করে তুলেছে।

আরও উল্লেখযোগ্য, ভিয়েতনাম শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বৈষম্য বাড়তে দেয়নি। ভিয়েতনামের জনগণের ৮১ শতাংশ ২০১৭ সালে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় এসেছে। জনসংখ্যা নীতির ব্যাপারে ভিয়েতনাম কঠোরভাবে ‘দুই সন্তান নীতি’ অনুসরণ করছে, যে নীতিটা বাংলাদেশের বহু আগেই গ্রহণ করা উচিত ছিল। ২০১৬ সালে ভিয়েতনামের জিনি সহগ ছিল ০.৩৫৩। ভিয়েতনাম সক্রিয়ভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তি সৃষ্টিকে নিরুৎসাহিত করে চলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফলকে কয়েকটি নগরে কেন্দ্রীভূত না করে ভিয়েতনাম গ্রামীণ জনগণের মধ্যে উন্নয়নের সব ডাইমেনশনকে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর।

১৯৯৫ সালে ভিয়েতনাম আসিয়ানের সদস্য হয়েছে, একদা চরম শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০০০ সালে এবং পরবর্তী সময়ে গণচীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ‘ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হতে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে ভিয়েতনামকে। বৈদেশিক বিনিয়োগকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করছে ভিয়েতনাম। স্যামসাং, এলজি, অলিম্পাস, পাইওনিয়ার—এসব কোম্পানির দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় হাব এখন ভিয়েতনামে (ভিয়েতনামে যাওয়ার আগে স্যামসাং বাংলাদেশের কোরিয়ান ইপিজেডে ফ্যাক্টরি করার জন্য প্রবল আগ্রহ দেখিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল)। ভিয়েতনামে বার্ষিক বৈদেশিক বিনিয়োগপ্রবাহ ২০-২৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ এখনো তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে। ভিয়েতনামের ব্যাংকিং ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রয়েছে, কিন্তু উৎপাদনকারীদের কাছে এবং বিশেষত ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সুলভে ব্যাংকঋণের অভিগম্যতায় ভিয়েতনাম অনুকরণীয় নজির সৃষ্টি করেছে।

ভিয়েতনামে দুর্নীতির প্রকোপ অনেক কম। ভিয়েতনামের শ্রমশক্তি ও মানবপুঁজি বাংলাদেশের চেয়ে শিক্ষিত, দক্ষ এবং পরিশ্রমী। ভিয়েতনামের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন চমকপ্রদ। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে হটিয়ে মাঝেমধ্যে গণচীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে চলে যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানিতে সিঙ্গাপুরের পর ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে। চাল রপ্তানিতে থাইল্যান্ডকে হটিয়ে ভিয়েতনাম ভারতের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। কফি রপ্তানিতে ব্রাজিলের পর ভিয়েতনাম বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে। সাড়ে ৯ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ২০১৮ সালে ছিল ২৪৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার, আমদানি ব্যয় ২৩৬.৬৯ বিলিয়ন ডলার। (বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৩৭.০৭ বিলিয়ন ডলার।) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গণচীনের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে গণচীনের অনেক শিল্পকারখানা ভিয়েতনামে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রচর্চা দুর্বল হলেও তা ভিয়েতনামের একদলীয় সরকারব্যবস্থার চেয়ে বিশ্বের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ায় আমাদের গণতান্ত্রিক পরিচয় আমরা হারাতে বসেছি। অবশ্য সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণের ক্ষমতায়ন এবং গ্রাম সমবায়ের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে পথ দেখাতে পারে। সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতন্ত্রকে যুগোপযোগী সংস্কার করতেই হবে, সেটা উপলব্ধি করেই ভিয়েতনাম ‘দোই মোই’ বাস্তবায়ন করছে। ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে বুঁদ না হয়েও যে অর্থনৈতিক ‘মিরাকল’ ঘটানো সম্ভব, সেটারই প্রমাণ ভিয়েতনাম।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক