এফ আর টাওয়ারটি ভুল নকশার ফসল

মো. মাকসুদ হেলালী
মো. মাকসুদ হেলালী
বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. মাকসুদ হেলালী জাতীয় অগ্নিসনদ প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বনানীর অগ্নিদুর্ঘটনাকবলিত ভবন পরিদর্শন শেষে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান


প্রথম আলো: আপনি বনানীর দুর্ঘটনাকবলিত এফ আর টাওয়ার পরিদর্শন করেছেন। এ সময় রাজউকের চেয়ারম্যান ও প্রধান স্থপতি সঙ্গে ছিলেন। প্রধান স্থপতি আপনাকে মোবাইল ফোনে কিছু একটা দেখাচ্ছিলেন। কী দেখলেন?

মো. মাকসুদ হেলালী: ১৯৯০ সালের দিকে ভবনটি নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল রাজউক। তিনি তাঁর মোবাইল ফোনে ভবনটির অনুমোদিত মূল নকশাটি দেখান। প্রধান স্থপতি বলেছেন, ভবনটির অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তিনি এখন বুঝেছেন, কেন লিফট ও সিঁড়িগুলো ধোঁয়ায় ভর্তি ছিল।

প্রথম আলো: আপনি কী দেখলেন? ৬২ বছরেও পায়ে হেঁটে ১০ তলা উঠেছিলেন?

মাকসুদ হেলালী: ১০ তলা পর্যন্ত উঠেছিলাম। কারণ, তার ওপরে আগুন যায়নি।

প্রথম আলো: কী কী দেখলেন?

মাকসুদ হেলালী: নিচতলায় পাশাপাশি দুটি সিঁড়ি। একটি জরুরি নির্গমন (ফায়ার এক্সিট), অন্যটি সাধারণ সিঁড়ি। দুটিই অপ্রশস্ত। এর মধ্যে আইনানুযায়ী যা থাকার কথা, অগ্নি–সিঁড়ি তার চেয়ে অনেক ছোট। আবার একই বারান্দায় তিনটি লিফট পাশাপাশি, কোনো পৃথক্‌করণ নেই, যা একেবারেই আইনবিরুদ্ধ। সম্ভবত চারতলায় একটি জরুরি নির্গমন দেখেছি, কিন্তু সেটি ছিল তালাবদ্ধ। এর ওপরের তলায় আবার জরুরি নির্গমনের সামনে আবার একটি কক্ষ তৈরি করা। যে কারণে এখানে যে নির্গমন পথ আছে, সেটি কারও নজরে আসেনি। এ কারণে ধোঁয়ায় যখন সিঁড়ি ভরে গেছে, তখন মানুষ নামার কোনো পথ খুঁজে পায়নি। তারা উপায়ান্তর না দেখে ওপরের দিকে উঠেছে।

সাততলায় ‘আমরা’ নামের একটি অফিস দেখলাম। তারা বিধি মেনে একটি ফায়ার ডোর লাগিয়েছিল। কিন্তু অন্য কোনো স্থানে এ ধরনের দরজা না থাকায় সেটাও অর্থহীন হয়ে গেছে। এক তলা থেকে অন্য তলায় যাতে আগুন সহজে না ছড়ায়, সে জন্য একটি ভার্টিক্যাল সেপারেশন লাগে। যার উচ্চতা অন্তত ১ মিটার (৩.২৮ ফুট) হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা আছে ২ ফুটের কাছাকাছি। আগুন সাধারণত দুভাবে ছড়ায়, পাশে ও ওপরে যায়। তাই দেয়াল যথাযথ মাপের না থাকায় আগুন সহজে উল্লম্বভাবে প্রবাহিত হয়ে অন্য তলাকে গ্রাস করে। ইমারতটি যে ভুল নকশার ফসল, এটা তার প্রমাণ।

প্রথম আলো: ঢাকার অন্য বহুতল ভবনগুলোর কী অবস্থা তাহলে?

মাকসুদ হেলালী: এ রকম ত্রুটি যত্রতত্র দেখা যায়। প্রায় সব ইমারতের ক্ষেত্রেই তা সত্য।

প্রথম আলো: আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল ভবনটিও?

মাকসুদ হেলালী: এতেও ত্রুটি আছে। তবে এই ভবনের সুপরিসর ব্যালকনি একটি রক্ষাকবচ।

প্রথম আলো: আর কী কী বড় ত্রুটি বা আইনের ব্যত্যয় নিয়ে আমাদের নাগরিক জীবন চলছে?

মাকসুদ হেলালী: ইদানীং বহুতল ভবনগুলোতে কাচের ব্যাপক ব্যবহার দেখবেন। কিন্তু ব্যবহৃত কাচের অধিকাংশই আগুন নিরোধক নয়। বনানীর ভবনটিতে এক তলা থেকে পরের তলার ফায়ার সেপারেশন ঠিক ছিল না বলে আগুন এত দ্রুত ছড়ায়। যে স্থপতি কাচের নকশা করেছেন, তিনি আগুনের ঊর্ধ্বমুখী গন্তব্য বুঝতে পারেননি বা সতর্ক ছিলেন না। সিঁড়িগুলো হয়ে পড়েছিল একটি গনগনে চিমনি, যা নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত ধোঁয়ায় ভরিয়ে দেয়। সে কারণে পলায়নপর মানুষেরা কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করতে পারেনি। যদি আগুন প্রতিরোধের আলাদা দেয়াল এবং তার মধ্যে ফায়ার ডোর থাকত, তাহলে মানুষ সহজেই নিরাপদ স্থানে যেতে পারত।

প্রথম আলো: আগুন লাগলে মানুষ ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়, কিন্তু তারা তো ২০ মিনিটের আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে না। এই ২০ মিনিট তো বহু জীবন খোয়ানোর জন্য যথেষ্ট?

মাকসুদ হেলালী: দেখুন, আপনি ঠিক জায়গায় এসেছেন। আধুনিক ইমারত আইন তো সে কারণেই মানুষের জীবন এবং ভবন বা সম্পদ রক্ষাকে দারুণভাবে পৃথক করেছে। বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়াই মানুষ যাতে বাঁচে, সেই ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিটি ভবনে থাকতে হবে। প্রতিটি ফ্লোরে আগুন প্রতিরোধক দেয়াল বা ‘ফায়ার সেপারেশন ওয়াল’ এবং তাতে উপযুক্ত দরজা ও জানালা থাকতে হবে। আগুন শনাক্ত করা এবং সংকেত বা অ্যালার্ম যন্ত্র থাকার কথা ছিল। এসবই কিন্তু মৌলিক নকশার অংশ। আইন বলেছে, প্রতিটি ভবনে সিঁড়ি থাকবে দুটি। পাশাপাশি নয়, বরং দূরত্বে বা বিপরীতে থাকবে। সাধারণ সিঁড়ি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হলেও বিকল্প সিঁড়ি দিয়ে মানুষ বেরিয়ে যাবে। কিন্তু ভবনটির নির্মাতা রূপায়নের নকশায় দুটি সিঁড়ির কথা থাকলেও কার্যত একটি সিঁড়ি ছিল। বহুতল ভবনে বিকল্প সিঁড়িটি যেকোনো অবস্থায় ধোঁয়াশূন্য ব্যবস্থায় থাকবে।

প্রথম আলো: এই অনিয়মের নিয়ন্ত্রক কারা?

মাকসুদ হেলালী: এটা মূলত স্থপতি প্রতিষ্ঠানের দেখার কথা। কারণ, কাজটা একজন স্থপতির। আইন অনুযায়ী, এই ইমারত নির্মাণের যিনি দলনেতা ছিলেন, তাঁর স্থপতি হওয়ার কথা। বর্তমান আইনে স্থপতি ও প্রকৌশলীর এটা যৌথ দায়িত্ব।

প্রথম আলো: সাধারণত দেয়ালে দেয়ালে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকে। এগুলোর কি ব্যবহার ঘটেছিল?

মাকসুদ হেলালী: অত্যন্ত দুঃখজনক যে কোনো ধরনের বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ছিল না। ১০ তলা পর্যন্ত একটিতেও ছিল না। অথচ আইনে এটা রাখা বাধ্যতামূলক ছিল। আইনে এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় রেখেছে। ফার্স্ট এইড ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা থাকবে। তাতে একটি হোসপাইপ থাকবে। আমরা একটি দেয়ালে এ রকম একটি জায়গা দেখলাম, সেখানে একটি হোসপাইপও আছে। কিন্তু পাইপটি সচল করার জন্য যে পাম্প থাকার কথা, সেটা ভবনে ছিল না। লোক দেখানো একটি অর্থহীন হোসপাইপ ব্যবস্থা রেখে দিয়েছিল। তাই তা কাজেও লাগেনি।

প্রথম আলো: আগুন কীভাবে লাগল?

মাকসুদ হেলালী: সেটা পরিষ্কার নয়। শর্টসার্কিট বা কারও ভুলত্রুটি থেকেও ঘটতে পারে। তবে নকশাজনিত ত্রুটির বিষয়ে সরকারি মহলের এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় যে ভবনটি তৈরির সময় বিল্ডিং কোড ছিল না। তখনকার নিয়মরীতিও পালন করা হয়নি। আইন হলো প্রতিবার অকুপেন্সি বা ভাড়াটে বদল হবে, আর তখনই নতুন করে হালনাগাদ করা আইনের অধীনে ছাড়পত্র নিতে হবে। এই সনদ তারা পেয়েছিল। সুতরাং ভবনটি ২০০৬ সালের আগে নির্মিত হলেও এরপরে ১৮ তলাকে ২২ তলা করা হয়েছে। নতুন ভাড়াটেও এসেছে। সুতরাং নির্মাণের সময় অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থায় ত্রুটি থাকলেও তা শুধরে নিতে ভবনমালিক বা মালিকদের বাধ্য করার বহু সুযোগ ছিল। আর সেটা করা হলে এতগুলো প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব ছিল।

প্রথম আলো: গণপূর্তমন্ত্রী কি সে কারণেই বলেছেন, এটা দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড।

মাকসুদ হেলালী: রাজউক ত্রুটি থাকার বিষয়টি দুর্ঘটনার পর বুঝেছে তা তো নয়, তারা আগেও বুঝেছিল। সে কারণে এই মৃত্যুর জন্য তারা যে কিছুটা দায়ী, তাতে সন্দেহ কী। আর শুধু রাজউক নয়, বহুতল ভবন হওয়ার কারণে যৌথ দায় ফায়ার সার্ভিসকেও নিতে হবে। আরেকটি বিষয় বলি। ভবনটিতে সেলুন, রেস্তোরাঁ, বায়িং হাউস, কমিউনিটি সেন্টার—এ রকম বিচিত্র ভাড়াটে দেখলাম। অগ্নিনিরাপত্তা সনদ বলেছে, এ রকম ভবনগুলো আগুন প্রতিরোধে অতিরিক্ত কিছু পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু এই ভবনে তার কিছুই মানা হয়নি। আর গোটা বিশ্বেই মিশ্র বিপণিবিতানে একটা আগুন প্রতিরোধে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে।

প্রথম আলো: আইনে কার ক্ষমতা বেশি? ব্যর্থতার মূল দায় কার?

মাকসুদ হেলালী: বিল্ডিং কোডে অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের মহাপরিচালকের অনেক ক্ষমতা দেওয়া আছে, তিনি চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। আবার রাজউকও ওই ভবনে তালা ঝোলাতে পারত। এমনকি সিটি করপোরেশন ব্যবসা করার ছাড়পত্র দেয়, তারাও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু কেউই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রথম আলো: কিন্তু এখন তারা বলেছে, ওই এলাকার সব ভবনের মালিককে আইন মানতে নোটিশ দিয়েছিল।

মাকসুদ হেলালী: কেউ না মানলে কী করণীয়, তা কিন্তু আইনেই বলা আছে। কিন্তু তারা তা প্রয়োগ করেনি। আপস করেছে বা কোনো কারণে পারেনি। হয়তো এ ধরনের ভবনের অনুমোদন দিয়ে দিতে তাদের কাছে ওপর মহলের ফোন আসে। আর নির্মাণের পর কোনো শর্ত পূরণ করানো কঠিন। তা ছাড়া একটি খারাপ প্রথা আছে। ইমারত নির্মাণের আগে তারা কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে ছাড়পত্র দেয়। এরপর তা বাস্তবে অনুসরণ করা হলো কি না, তার খোঁজ রাখা হয় না। তবে নির্মাণের পরে অগ্নিনিরাপত্তাবিষয়ক ত্রুটি দূর করা সহজ।

প্রথম আলো: বনানীর এফ আর টাওয়ারটির বিষয়ে কী বলবেন?

মাকসুদ হেলালী: আমি হিসাব করে দেখেছি, এই ২৩ তলা ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তায় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা খরচ করলেই চলে, যা ভবনটির এক মাসের ভাড়ার সমান মাত্র। সুতরাং এটা অর্থাভাব নয়, ইচ্ছা বা জ্ঞানের অভাব।

প্রথম আলো: ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে ১১৩ এবং রানা প্লাজায় ১ হাজার ১০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর পর অগ্নিনিরাপত্তায় সামাজিক, প্রশাসনিক ও আইনি অগ্রগতিকে কীভাবে দেখেন?

মাকসুদ হেলালী: ইতিবাচক পরিবর্তন যথেষ্টই হয়েছে, তবে সেটা কেবল পোশাক খাতে। এই খাতে ৮০ ভাগ অগ্রগতি হলে বাকি সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন ১০ ভাগের বেশি নয়। এমনকি পরিত্যক্ত ঘোষিত গার্মেন্টস ভবনগুলো অন্যভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আসলে মনমানসিকতা বা চেতনাগত তেমন পরিবর্তন আমাদের হয়নি।

প্রথম আলো: এখন তাহলে করণীয় কী?

মাকসুদ হেলালী: প্রতিটি বহুতল ভবনের অনুমোদিত মূল নকশার সঙ্গে বর্তমানে যেভাবে আছে, তার মিল-অমিল দেখা এবং ভাড়াটে বদল হওয়ার ‘অকুপেন্সি সনদ’ পরীক্ষা করা। ‘অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ’ দুই ধরনের আগুন প্রতিরোধকব্যবস্থা আছে। অ্যাকটিভ হলো সম্পদ ও ইমারত রক্ষা। তাই এখন প্যাসিভ ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হোক। তার মানে বহুতল ভবনে আগুন লাগলেও মানুষ যেন প্রাণে বাঁচতে পারে। যেখানেই এ বিষয়ে ত্রুটি থাক, তা অগ্রাধিকার দিয়ে শুধরে নেওয়া দরকার। সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ডে মানুষের জীবন হেলিকপ্টার বা ফায়ার সার্ভিস–নির্ভর রাখা যাবে না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মাকসুদ হেলালী: ধন্যবাদ।