সস্তা মানুষের দেশে উন্নয়ন

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্বল গণতন্ত্র, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, অদক্ষ বন্দরব্যবস্থা, যানজটে বিশৃঙ্খল যোগাযোগব্যবস্থা, লাগামহীন দুর্নীতিসহ হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে। প্রতিবছর অর্থনীতি বড় হচ্ছে, বছরে বছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে চলেছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমাদের সরকার অনুমান করেছিল, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি আরও বেড়ে ৮ শতাংশের কাছাকাছি হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রথম ৮ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে যে চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে সরকারের প্রত্যাশা আরও বেড়েছে। এখন সরকার বলছে, চলতি অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।

আমাদের অর্থনীতির এই গতিময়তা বিস্ময়কর। কারণ, শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসা–বাণিজ্যসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেগসঞ্চারের জন্য যে পরিবেশ প্রয়োজন, বাংলাদেশে তার প্রকট ঘাটতি রয়েছে। বিশ্বের কোন দেশে ব্যবসা–বাণিজ্যের পরিবেশ কতটা অনুকূল, তার একটা তূলনামূলক চিত্র নিয়মিতভাবে তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক। তারা এটার নাম দিয়েছে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স’, বাংলায় বলা যেতে পারে সহজে ব্যবসাবিষয়ক সূচক। এই সূচকে বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। অর্থাৎ তালিকার প্রায় তলানিতে। ১৭৫টি দেশ আমাদের থেকে এগিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সবচেয়ে পেছনে রয়েছি। এমনকি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জর্জরিত দেশ আফগানিস্তানের অবস্থাও আমাদের চেয়ে ভালো।

বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেক্সেও বাংলাদেশের অবস্থান ভালো নয়; ২০১৮ সালের এই সূচকে বিশ্বের ১৬০টি দেশের মধ্যে আমরা ১০০তম। আমাদের যোগাযোগ অবকাঠামো অপ্রতুল, পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার অদক্ষতা ও অনিশ্চয়তা খুব বেশি। সড়ক–মহাসড়কে বিশৃঙ্খলাজনিত যানজটের ফলে পণ্য পরিবহনের গতি দিনে দিনে কমে যাচ্ছে; ঘাটে ঘাটে পণ্যবাহী যানবাহন দাঁড় করিয়ে চাঁদাবাজি তো আছেই।
বন্দরের দুরবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে; দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশ থেকে পণ্যবাহী জাহাজ এসে ভেড়ার পর সেটা থেকে পণ্য খালাস করার পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে ১৫ দিনের বেশি সময় লেগে যায়। অথচ একই প্রক্রিয়া শেষ করতে দক্ষিণ কোরিয়ার বন্দরগুলোতে লাগে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ দিন।

এসব সীমাবদ্ধতাসহ আরও অনেক কারণে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি উৎসাহব্যঞ্জক নয়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, সচরাচর যেসব মানদণ্ড দেখে বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগ করতে যান, সেগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশে নেই। সে কারণে আমরা দেখছি, এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসছে না। দেশি বিনিয়োগও প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়ছে না। বিনিয়োগ না বাড়লে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না; কিন্তু জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে বলে বেকারত্বও বেড়ে চলেছে। সামগ্রিক বিবেচনায় এ রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। দেশি–বিদেশি অনেক গবেষক, অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন–বিশারদ বাংলাদেশের এই উন্নয়নকে ‘ইকোনমিক মিরাকল’, ‘মিরাকুলাস ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট’ ইত্যাদি বলে প্রশংসা করেন। মিরাকুলাস মানে অলৌকিক; বস্তুত অর্থনীতিতে অলৌকিকভাবে কিছুই ঘটে না, যা ঘটে তার সবই মানুষের কর্মতৎপরতার ফল। বাংলাদেশেও সেটাই ঘটেছে এবং আপাতত ঘটে চলেছে।

কিন্তু কীভাবে? কিসের জোরে এই অসম্ভব সম্ভব হচ্ছে?

এই প্রশ্নের একটা উত্তর খুঁজে পাওয়া গেল জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফলে। সংস্থাটির জরিপে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৯টি দেশে বিনিয়োগকারী জাপানি কোম্পানিগুলোর লোকবলের মজুরি ও বেতনের যে তুলনামূলক চিত্র উঠে এসেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে উৎপাদন খাত ও সেবা খাত উভয় খাতের শ্রমিক, প্রকৌশলী, ব্যবস্থাপকসহ সব শ্রেণির লোকবলের মজুরি ও বেতন সবচেয়ে কম। উৎপাদন খাতে ন্যূনতম তিন বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন নিয়মিত শ্রমিকের মাসিক মজুরি বাংলাদেশে ১০৯ মার্কিন ডলার। ভারতে একই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন শ্রমিকের মাসিক মজুরি ২৬৫ মার্কিন ডলার। ভারতের শ্রমিকেরা আমাদের শ্রমিকদের চেয়ে ছয় ধাপ ওপরে চলে গেছেন। ভারতের পরেই আছে ভিয়েতনাম, সে দেশে একজন শ্রমিকের মজুরি ২২৭ ডলার, তার নিচেই কম্বোডিয়া, সেখানে একজন শ্রমিক পান ২০১ ডলার।

শুধু শ্রমিক নয়, স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীদের বেতনও বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম। জেট্রোর জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে একজন প্রকৌশলীর মাসিক বেতন ২৮৭ মার্কিন ডলার, ভিয়েতনামে ৪৩৯ ডলার, আর কম্বোডিয়ায় ৬৪৮ ডলার। পাকিস্তান ও ভারতে যথাক্রমে ৪৯২ ডলার ও ৫৯১ ডলার। উৎপাদন খাতের একজন ব্যবস্থাপকের মাসিক বেতন বাংলাদেশে ৭৯৩ ডলার, ভিয়েতনামে ৯৩১ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১১১৭ ডলার, পাকিস্তানে ১২৩৫ ডলার এবং ভারতে ১৩৮২ ডলার।

উৎপাদন ও সেবা উভয় খাতের মালিক–পুঁজি লগ্নিকারীদের জন্য এটা খুব সুখের বিষয় যে বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তায় লোকবল পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, এর ফলে সব পণ্যের উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে। জেট্রোর জরিপেই দেখানো হয়েছে, যে পণ্য জাপানে উৎপাদন করতে ১০০ ডলার খরচ হবে, সেটাই বাংলাদেশে উৎপাদন করা যাচ্ছে প্রায় অর্ধেক খরচে, ৫১ ডলারে। জরিপের অন্তর্ভুক্ত ১৯টি দেশের আর কোনোটিতেই এত কম খরচে ওই পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কায় খরচ হয় ৬১ ডলার, কম্বোডিয়ায় ৬৩ ডলার, ভিয়েতনামে ৭৩ ডলার, মিয়ানমারে ৭৬ ডলার, ভারতে ৭৭ ডলার, আর পাকিস্তানে ৮২ ডলার।

শ্রম সস্তা, ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কম। তার মানে মালিক বা পুঁজি লগ্নিকারীদের মুনাফা বেশি। তাঁদের ধনসম্পদ বাড়ছে শনৈঃ শনৈঃ। তবে কি এটাই আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধির মোদ্দা কথা? এটাই বাংলাদেশের ইকোনমিক মিরাকলের প্রধান রহস্য? তা যদি হয়, তাহলে এটা ভালো কথা নয়। প্রধানত সস্তা শ্রমের ওপরে নির্ভরশীল এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নির্মম দিকটা লক্ষ করা প্রয়োজন। পণ্য উৎপাদনের খরচ কম হচ্ছে প্রধানত এই কারণে যে খুব সস্তায় শ্রম কেনা যাচ্ছে। মালিক যন্ত্র কিনছেন আন্তর্জাতিক বাজারদরে, কাঁচামাল কেনায় কিংবা জ্বালানির খরচেও তাঁর সাশ্রয় করার সুযোগ তেমন নেই; উৎপাদন প্রক্রিয়ায় খরচের যত খাত আছে, তার কোথাও খরচ করতে মালিকের কার্পণ্য দেখানোর সুযোগ নেই। কার্পণ্য করা যায় শুধু মানুষের বেলায়, যে মানুষ শ্রম বিক্রি করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। যে মানুষ দিনরাত শ্রম বিক্রি করে সন্তানসন্ততি নিয়ে বেঁচেবর্তে থাকার প্রাণান্তকর সংগ্রামে লিপ্ত।

বাংলাদেশে শ্রম এত সস্তা কেন? এই জন্য যে আয়তনের তুলনায় এ দেশের জনসংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। এ দেশে এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করছে ১ হাজার ১১৫ জন মানুষ। বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ চীন, সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১৪৫ জন, জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় দেশ ভারতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪১৬ জনের বাস। ভিয়েতনামে ২৯৯ জন আর কম্বোডিয়ায় মাত্র ৮২ জন।

বাংলাদেশে শ্রম এত সস্তা এই কারণে যে শ্রম বিক্রি করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত মানুষের সংখ্যার তুলনায় কাজের ক্ষেত্র একেবারেই কম। লাখ লাখ মানুষ বেকার। অতি অল্প মজুরিতেও তারা কাজ করতে রাজি, কিন্তু কাজ কোথায়? কর্মসংস্থানপ্রত্যাশী বিপুলসংখ্যক মানুষের এই নিরূপায় দশাই যখন সস্তা শ্রমের কারণ, তখন পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের স্বার্থের পাহারাদার শাসক শ্রেণি জনঘনত্ব বৃদ্ধিকে সমস্যা হিসেবে দেখবে না, এটা সহজেই বোধগম্য। তাই আমরা তাদের মুখে এমন কথা প্রায়ই শুনি যে বড় জনসংখ্যা সমস্যা নয়, বরং সম্পদ।

কিন্তু এটা অমানবিক; একুশ শতকের পৃথিবীতে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পুঁজিবাদের আদি পর্বের মতো এই নির্মম অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুরো সমাজের সামগ্রিক ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না। প্রযুক্তির আরও অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ও সেবা খাতে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহার বাড়তে থাকলে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পসহ অনেক শিল্পে, এমনকি কৃষি খাতেও মানুষের কর্মসংস্থান কমতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সব কর্মসূচিতে যে শৈথিল্য চলছে, তা চলতে থাকলে জনসংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলবে। এর মধ্যে ধনবৈষম্যের তীব্রতা যেভাবে বেড়ে চলেছে, সেভাবেই বাড়তে থাকলে আমরা একটা সময়ে গুরুতর সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারি।

মশিউল আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক