'ব্যবহারযোগ্য নয়' সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিন

আমরা যেন মৃত্যুর ফাঁদে পড়েছি
আমরা যেন মৃত্যুর ফাঁদে পড়েছি

আমরা যেন মৃত্যুর ফাঁদে পড়েছি। সড়কে বের হলে আবরারের মতো প্রাণ যাবে। বাড়িতে থাকলে আগুনে পুড়ে মরতে হবে। চকবাজারের রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগা এবং সরু রাস্তার কারণে মানুষ পালাতে পারেনি। পুরান ঢাকার অনেক কিছুরই ঠিক-ঠিকানা নেই। কিন্তু এবার আমরা কী বলব?

বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ অভিজাত এলাকা। সেটা নতুন ঢাকা। কিন্তু পুরান ঢাকার চকবাজার আর বনানীর মধ্যে কোনো ফারাক থাকল না। দুই ক্ষেত্রেই আইনকানুন মেনে দালান তৈরি করা হয়নি। তাই দুটি অগ্নিকাণ্ডেই এত মানুষের মৃত্যু হলো। গত কয়েক দিনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলার পর অসহায়ত্বের বোধ আরও তীব্র হয়েছে। কারণ, সবারই সবকিছু জানা আছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের নিষ্ঠা ও কর্তব্যবোধ আমাদের মুগ্ধ করে। ছয় বছর দায়িত্ব পালন শেষে গত ২৬ মার্চ অবসরে গেছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক। ফায়ার কোড অমান্যকারী অন্তত এক শ বহুতল ভবনের (দশতলার ওপরে) তালিকা তাঁর হাতে ছিল। যদিও এসব ভবনের অধিকাংশই ইমারত ও ফায়ার কোড আসার আগে তৈরি হয়েছে। এফ আর টাওয়ারের ক্ষেত্রেও সেটা সত্য। তিনি আমাদের বললেন, ফায়ার সার্ভিসকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। নির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলাম, বিদ্যমান আইন আপনাকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। একটি ভবনও আপনি বন্ধ করলেন না কেন? তাঁর উত্তর ছিল, প্রচলিত আইন তাঁকে তাৎক্ষণিক তেমন সিদ্ধান্ত নিতে সেই ক্ষমতা দেয়নি। তিনি শুধু মামলা দায়ের করতে পারেন, যা তিনি কিছু ক্ষেত্রে করেছেন। গণপূর্তমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, বনানীর ঘটনাটি দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। এখন আমরা দেখলাম, ভবনটির একটি অংশের একজন মালিক গ্রেপ্তার হয়েছেন।

১৯৫৯ সালের ফায়ার সার্ভিস অধ্যাদেশ বাতিল করে ২০০৩ সালের ৬ মার্চে আমরা প্রথমবারের মতো অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন পাই। ৬ মার্চের পরের ১৮০ দিনের মধ্যে সব ইমারত মালিক ও দখলদারের অগ্নিবিধি পূরণ করে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। যাঁরা এটা নেননি, তাঁদের ইমারত ‘অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে অনুপযোগিতার কারণে ব্যবহার উপযোগী নয়’ ঘোষণার ক্ষমতা মহাপরিচালককে দেওয়া হয়েছে ৮ ধারায়। এরপর সরকার ১৯৬১ সালের ফায়ার সার্ভিস রুলস বাতিল করে ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নতুন অগ্নিবিধি জারি করেছিল। এর বিধি ২০ বলেছে, ওই ঘোষণা সত্ত্বেও যাঁরা ভবন ব্যবহার করবেন, মহাপরিচালক তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। শাস্তি অনধিক এক বছর জেল এবং তার অতিরিক্ত অর্থদণ্ড।

এখন আমরা নতুন গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের কথায় ভরসা রাখতে চাই। আইন অনুসরণ না করার যে ধারা এত দিন চলছিল, তার অবসান হোক। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের প্রবাদও মনে রাখতে হবে। কয়েকটি বৃহৎ হোটেল ছাড়া আর কেউ ফায়ার কোড মেনে চলে না।

জাতীয় ফায়ার কোডের অন্যতম প্রণেতা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাকসুদ হিলালিকে বললাম, এমন একটি বিষয় বলুন, যা নিশ্চিত করা গেলে ইমারতগুলো নিরাপদ হবে। তিনি বললেন, ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ব্যবহারযোগ্যতার সনদ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ভবন ব্যবহারের সম্পূর্ণ উপযোগী হয়েছে কি না, তা সামগ্রিকভাবে খতিয়ে দেখার পরেই সার্টিফিকেট অব অকুপেন্সি (সিও) বা ভবনটি ব্যবহারের লিখিত অনুমতিপত্র দেওয়ার নিয়ম। এতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলোও নিশ্চিত করা হয়। আগুন লাগলে তা দ্রুত নেভানোর ব্যবস্থা, লোকজনের দ্রুত ভবন ত্যাগ করার জন্য জরুরি প্রস্থানপথ ইত্যাদি সব সুরক্ষা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ঠিকমতো নেওয়া হয়েছে কি না, তা সরেজমিন পরীক্ষা করার দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসের।

২০০৬ সালে সংসদে জাতীয় ইমারত কোড সংসদ আইনে পরিণত করেছে। এরই একটি অংশ হলো ফায়ার কোড। এটি হালনাগাদ করা হয়েছে ২০১৫ সালে, কিন্তু তা আইনে পরিণত হয়নি। স্থপতি মোবাশ্বের হাসান শোনালেন ভিন্নকথা। ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও স্থপতিরা অনেক সংগঠিত, তাঁরা নকশা অনুমোদনের পূর্ণাঙ্গ এখতিয়ার চান। এ নিয়ে মত-দ্বিমত আছে। সংসদে সংশোধিত কোড পাসে বিলম্বের এটাও কারণ।

অবশ্য যে আইন ও বিধিবিধান আছে, সেগুলো কার্যকর করেও পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি ঘটানো সম্ভব। অগ্নিনিরাপত্তা বলতে বনানীর ওই ভবনে কিছুই ছিল না। তাজরীন, রানা প্লাজা, নিমতলী, চকবাজার কোনোটিই আমাদের নাগরিক সচেতনতায় আঘাত করে না। করলে মন্ত্রী-মেয়র কী বলেছেন, তার অপেক্ষায় মানুষ থাকত না। নিজের স্বার্থ পাগলেও বোঝে, কিন্তু বহুতল ভবনের শিক্ষিত, সচেতন ও প্রভাবশালীদের কাণ্ডকীর্তি তা প্রমাণ করে না। ফায়ার সার্ভিসের ওয়েবসাইটে নাগরিক সনদ এবং অগ্নিপ্রতিরোধক চেকলিস্ট দেওয়া আছে। তা পড়ে মনে হলো কোথাও হঠাৎ আগুন লাগতে পারে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। এমন বিধান করা আছে, যা মানা হলে একটি ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে আগুন যেতে অন্তত চার ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু তা এফ আর টাওয়ারে ছিল না। কারণ, বিনিয়োগ বাড়ত। অগ্নিনির্বাপণে এক কোটি টাকা খরচ করলেই দুর্ঘটনার এই ভয়াবহতা ও বিপর্যয় এড়ানো যেত।

রাজউকের যেসব কর্মকর্তা ইমারত নির্মাণের অনুমতিপত্র প্রদান করেন তাঁরা লেখেন, কতগুলো শর্তে ইমারত নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হলো। কিন্তু শর্তগুলো মেনে ইমারত বানানো হলো কি না, সেদিকে আর ফিরেও তাকানো হয় না। ইমারত নির্মাণের পর সেখানে বসবাস শুরু করার আগে কোনো অনুমোদন কেউ নেন না। তাই আমরা মনে করি, রাজউকের উচিত প্রতিটি ইমারত নির্মাণের অনুমোদনপত্র ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। এতে অনুমোদনের ফাঁকগুলো প্রকাশ পাবে।

ঢাকায় সাত লাখের বেশি দালান। অধিকাংশ ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে তথাকথিত ‘কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে’। পুরান ঢাকার চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের প্রাণহানির পর আমরা শর্তগুলোর বাস্তব প্রতিপালনের দশা দেখতে চেয়েও পারিনি। এবার নতুন ঢাকার বনানীতে ২৬ জনের প্রাণহানির পর আমরা ঢাকার প্রতিটি বহুতল ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই। যেসব ভবনে শর্তানুযায়ী অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত করা হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। বনানীর ইমারতটিতে সেই ব্যবস্থা না থাকায় সেটির কর্তৃপক্ষের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। বাংলাদেশে ফায়ার কোড লঙ্ঘনের শাস্তি অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড। কিন্তু এ দেশে এ পর্যন্ত কারও শাস্তি হয়েছে বলে জানা যায় না। দায়মুক্তির এই জিঞ্জির ভেঙে যাক।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি বলেছেন, সরেজমিন পরিদর্শনের পর অগ্নিনিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ভবন ব্যবহারের অনুমোদনপত্রে যাঁরা স্বাক্ষর করবেন, তাঁদের শাস্তি পেতে হবে। আমাদের দেশেও একই প্রক্রিয়ায় ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণের বিধান বাধ্যতামূলকভাবে পালন করতে হবে। তবে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেছেন, চিহ্নিত বহুতল ভবনগুলোকে দেওয়া সময়সীমা আর এক বা দুই মাস পর শেষ হবে। আমাদের প্রস্তাব হলো, নতুন মহাপরিচালকের এ জন্য অপেক্ষার দরকার নেই। আর কালবিলম্ব না করে তিনি যেন তাঁর ৮ ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।

বাইরে থেকে ঝকঝকে-তকতকে দেখতে বহুতল ভবনগুলোর যদি অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ঠিক না থাকে, তবে তাতে ‘ব্যবহার উপযোগী নয়’—এমন সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিতে হবে। এতে অন্তত হইচই পড়বে এবং সেই ভবনের লোকজন জানবেন যে এটা তাঁদের জন্য নিরাপদ নয়। তখন চাপ বাড়বে। বর্তমান আইনে যেহেতু তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ভবন বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা ফায়ার সার্ভিসের নেই, সে ক্ষেত্রে তারা অন্তত কোন কোন ভবনগুলো ব্যবহার উপযোগী নয়, তেমন তালিকা ঘোষণা ও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিতে পারে।

এমন সাইনবোর্ড ঝোলাতে গেলে একটা হইচই পড়ে যাবে। সাইনবোর্ড ঠেকাতে অনেকেই তদবিরে নেমে পড়বেন। এখানে কঠোর অবস্থান বজায় রাখতে হবে। কোনো ভবনে এমন কলঙ্কতিলক পড়লে সামাজিক লজ্জা ও চাপের কারণেও হয়তো অনেক শিল্পপতি নিজেদের ভবনগুলোকে উপযোগী করার উদ্যোগ নেবেন।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]