সুখী মানুষেরা একত্রে থাকে

প্রতিবছর ২০ মার্চ ‘বিশ্ব সুখ দিবস’ পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সুখী মানুষেরা একত্রে থাকে’। এই প্রতিপাদ্যের তাৎপর্য হচ্ছে, আপনি মানবজাতির যে বিভেদ, বিদ্বেষ সেটিকে উসকে না দিয়ে, মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি না করে, আমরা যেন মানবজাতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য, প্রয়োজন ও প্রবণতার দিকে বেশি মনোযোগ দিই। যে জাতিগত ও ধর্মীয় উগ্রবাদ আমাদের বিচ্ছিন্নতা, বিভক্তি বাড়াচ্ছে, তার বিপরীতে আমাদের একত্রে থাকতে হবে, একসঙ্গে থাকতে হবে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের বিয়োগান্ত ঘটনার পর সে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও জনগণ যেভাবে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা, সংহতি প্রকাশের যে অনন্য নজির স্থাপন করেছে, তা অন্যদের জন্য একটি বড় উদাহরণ হতে পারে।
আমরা বিভক্ত সমাজ চাই না, একত্র মানবজাতি চাই। আর একসঙ্গে থাকা মানুষেরাই সুখী মানুষ। বিচ্ছিন্ন, অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা সন্ত্রাসীরা কখনো সুখী মানুষ হতে পারে না। এক গবেষণায় (২০০৫) প্রমাণিত হয়েছে যে সুখী মানুষেরা অন্যদের থেকে জীবনে অধিক সফল হন, দীর্ঘজীবী হন ও অধিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন। মনে রাখতে হবে অসুখী মানুষ হতাশ, ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ ও বেপরোয়া। তাঁদের দ্বারা আর যা–ই হোক, শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০১৮ অনুযায়ী, ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫-তে। ভারতের ১৩৩। সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় রয়েছে ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড। ঘুরেফিরে এরাই বারবার সুখী দেশের তালিকায় থাকে। সবচেয়ে কম সুখী দেশের তালিকায় রয়েছে বুরুন্ডি, সাউথ সুদান, তানজানিয়া, ইয়েমেন।

পশ্চাৎপট
১৯৭২ সালে তৎকালীন বোম্বেতে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ভুটানের সাবেক রাজা প্রথম জিএনএইচ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) টার্মটি ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, ‘জিএনপির (গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট) চেয়ে জিএনএইচের গুরুত্ব অনেক বেশি।’
এরপর ২০০৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট দ্বিতীয় জিএনএইচের প্রবর্তন করে। ২০০৬ সালে এই প্রতিষ্ঠান আমেরিকায় জিএনএইচ বাস্তবায়নের
জন্য পলিসি হোয়াইট পেপার প্রকাশ করে। ২০০৭ সালে থাইল্যান্ড সরকার জিএইচআই (গ্রিন অ্যান্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্স) প্রকাশ করে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালাপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ওয়েল বিয়িং ইনডেক্স চালু করে। ২০১০ সালে সেন্টার ফর ভুটান স্টাডিজ তাদের পূর্বতন চার স্তম্ভের বদলে সুখের উপাদান হিসেবে আটটি উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করে। সেগুলো হলো শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য, সময়ের ভারসাম্য, সমাজ ও কমিউনিটির প্রাণশক্তি, সাংস্কৃতিক প্রাণশক্তি এবং শিক্ষা, জীবন-মান, সুশাসন ও পরিবেশ প্রাণশক্তি। ২০১১ সালে কানাডা সিআইডব্লিউ (কানাডিয়ান ইনডেক্স অব ওয়েল বিয়িং) প্রকাশ করে। ২০১২ সালে জাতিসংঘ ২০ মার্চকে বিশ্ব সুখ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

সুখ কি মাপা যায়?
এমন কোনো বাটখারা কি রয়েছে, যা দিয়ে সুখের পরিমাণ মাপতে পারি? মনোবিদেরা তেমন মাপনযন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। এই মাপনযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে ১. পিএএনএএস (পজিটিভ অ্যান্ড নেগেটিভ এফেক্ট শিডিউল), ২. এসডব্লিউএলএস (স্যাটিসফেকশন উইথ লাইফ স্কেল) ও ৩. এসএইচএস (সাবজেকটিভ হ্যাপিনেস স্কেল)।
সুখ কী? সুখের সংজ্ঞা কী, সুখ কোথায়, কোথায় এর ঠিকানা, সুখের কি কোনো গোপন রেসিপি রয়েছে, নাকি সুখ কেবলই সোনার হরিণ? এসব প্রশ্ন আদিকাল থেকে মানবমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সুখের প্রচুর সংজ্ঞা রয়েছে, তবে কোনোটাই সর্বজনস্বীকৃত নয়। রবার্ট হোলডেন সুখের একটি সংজ্ঞা এভাবে দেন ‘বাহ্যিক উপাদানের সঙ্গে সুখ শর্তযুক্ত বা সুখ কিনতে পাওয়া যায়—এ রকম বিশ্বাসকে মাইনাস করে, আপনার যে প্রকৃত অবস্থান, সুখ সেটিই।’ রবার্ট হোলডেন ‘ডেসটিনেশন এডিকশন’ বলে একটি টার্ম ব্যবহার করেন। এর মানে সুখের পেছনে হন্যে হয়ে যাঁরা সারা জীবন দৌড়ান, সেটি একধরনের নেশা। আমরা অনেকেই সুখের সোনার হরিণের পেছনে ছুটে সারা জীবন পার করে দিই। তবু মনে হয় সুখের নাগাল তো পেলাম না।

তাহলে সুখ কোথায়?
মনোবিদেরা বলেন, সুখ কোনো বিশেষ জায়গায় নয়, সুখ নির্ভর করে কীভাবে আপনি জীবন যাপন করেন তার ওপর। আপনি কিসের ওপর বেশি মূল্য দেন? অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা? এই মুহূর্তে কী আপনাকে সুখী করতে পারে? এসব বিষয়ে একেকজনের একেক মত থাকবে। তা ছাড়া যা আপনাকে সুখী করবে তা অন্যকে না–ও করতে পারে। তবে এত কিছু সত্ত্বেও পজিটিভ সাইকোলজি বলে, আমরা সুখ সৃষ্টি করতে পারি, সুখ বৃদ্ধি করতে পারি এবং নিশ্চিতভাবে সুখী হতে পারি।

কীভাবে সুখী হবেন
ডোপামিন নামক একটি নিউরোট্রান্সমিটারকে ‘ভালো লাগার হরমোন’ বলা হয়। গভীর ভালোবাসা বা মাদক যে তীব্র আনন্দ দেয়, তা এই ডোপামিনের জন্যই। নানা প্রক্রিয়ায় আমরা ব্রেইনের ডোপামিন লেভেল বাড়াতে পারি।
তবে নিয়মিত ব্যায়াম করুন, আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করুন, জীবনে যা পেয়েছেন, হয়েছেন তার হিসাব করুন, কী পাননি তা নয়—কোনো বিষয়েই কারও সঙ্গে নিজেকে তুলনা করবেন না। কেননা, মূলত জীবনে তুলনা বলে কিছু নেই। আপনি এ পৃথিবীতে অনন্য ও অসাধারণ। এ জীবনে যা পেয়েছেন, হয়েছেন তার জন্য গর্ব ও তৃপ্তি অনুভব করুন। বর্তমানে বাঁচুন, বর্তমানে জীবন যাপন করুন, অতীত, ভবিষ্যৎ বা অন্য কিছু যেন মনোযোগকে বিঘ্নিত করতে না পারে—একে আমরা বলি মাইন্ডফুলনেস; যারা আনন্দ দেয়, সম্মান করে, তাদের সঙ্গে থাকুন। যা করছেন গভীর মনোনিবেশ দিয়ে করুন, এর মধ্যে ডুবে থাকুন—একে বলে ফ্লো। আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান বৃদ্ধি করে তেমন কিছু করুন। যা কিছু ভালো তা ধরে রাখুন, যা কিছু মন্দ সেসব ‘চলে যেতে’ দিন। ভালোবাসুন—মানুষকে, প্রাণীকে, প্রকৃতিকে। বেরিয়ে পড়ুন, ঘুরতে যান, প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকুন। ভালো আছি, সুখে আছি—এটি হোক নিত্যদিনের জপমন্ত্র। শেয়ার করুন নিজের আনন্দ সুখকে। জীবনে অনেকভাবে বাঁচা যায়, এক পথ বন্ধ হলে শত পথ খুলে যাবে।

ড. মো. তাজুল ইসলাম অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
[email protected]