মানবাধিকার ও মারণাস্ত্রের কারবারিরা

এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা—পৃথিবীর যে প্রান্তেই গণতন্ত্র বা মানবিকতা যখন বিপন্ন হয়, তা নিয়ে সরব হয় আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো। তাদের চোখে নিজ স্বার্থে গণতন্ত্র ও মানবিকতা বিপন্ন হলে শুধু ওই সব দেশের সরকারই নয়, ইউরোপ-আমেরিকার নানা গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান উচ্চকণ্ঠে সমালোচনায় সরব হয়। তবে একটি বিষয়ে এসব দেশে সরকার ও সংগঠনগুলো মোটেও সরব হয় না, সেটি হলো তাদের সমরাস্ত্র ব্যবসা ও তাদের দ্বারা অহরহ বিশ্ব মানবিকতা লঙ্ঘনের ঘটনা।

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, আধিপত্যবাদ, নিজেদের মধ্যে হানাহানি এখন ইতিহাস। সুষম সমাজব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিংশ শতাব্দীতে যে সামাজিক বিপ্লব ঘটেছিল, শতাব্দী শেষে ওই ব্যবস্থাগুলোর পতন ঘটেছে। সমতাভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য আপাতত ‘লোকান্তরিত’। একবিংশ শতাব্দীর যাত্রা শুরু হয়েছে পুঁজির বিশ্বায়ন বা শাসন, শোষণ ও আধিপত্যবাদের নতুন কৌশল দিয়ে। ঔপনিবেশিক যুগে পশ্চিম ইউরোপ পৃথিবীজুড়ে তাদের উপনিবেশ-দখলদারি দিয়ে পৃথিবীর ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর আজকের বিশ্ব পুঁজির নিয়ন্ত্রক হয়েছে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।

সম্প্রতি স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বিশ্বের বড় বড় সমরাস্ত্র বিক্রেতা ও ক্রেতা দেশ নিয়ে একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা তাদের সর্বশেষ গবেষণায় জানাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী অস্ত্র ব্যবসা এখন খুবই রমরমা এবং বিক্রেতাদের তালিকা দেখলে প্রথমেই আসবে আমেরিকা আর ইউরোপের নাম। সারা বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানি বাণিজ্যের তিন-চতুর্থাংশই করে পাঁচটি দেশ। দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি
ও চীন। এই পাঁচটি দেশ ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের নানা দেশে ৭৫ শতাংশ অস্ত্রের জোগান দিয়েছে।

সুইডিশ সংসদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটটি জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক সামরিক বিষয়ে তথ্য, বিশ্লেষণ, সুপারিশসহ বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ ও মিডিয়ায় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করছে। এই ইনস্টিটিউট মূলত সুইডিশ সরকারের অর্থায়নে চালিত। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তারা সমরাস্ত্রবিষয়ক গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করে থাকে। সদ্য প্রকাশিত গবেষণার মতে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসা বিগত পাঁচ বছরের (২০০৯ থেকে ২০১৩) তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে মানুষ নিধনকারী এই মারণাস্ত্রের ক্রেতা কারা! সর্বোচ্চ পাঁচটি ক্রেতা দেশ হলো সৌদি আরব, ভারত, মিসর, অস্ট্রেলিয়া ও আলজেরিয়া। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো গত পাঁচ বছরে অস্ত্র আমদানি প্রায় দ্বিগুণ করেছে। মারণাস্ত্র বিক্রির তালিকায় থাকা ১ নম্বর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ অস্ত্রের জোগানদাতা। এদের অর্ধেকেরও বেশি অস্ত্রের ক্রেতা মধ্যপ্রাচ্য। তবে পৃথিবীর ৯৮টি দেশ বিগত পাঁচ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কিনেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রযুক্তির মানববিধ্বংসী এসব অস্ত্রের মধ্যে যুদ্ধবিমান, স্বল্প পরিসীমার মিসাইল, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমা ইত্যাদির চাহিদা ক্রেতা দেশগুলোর কাছে বেশি।

এই মুহূর্তে রাশিয়া পৃথিবীর অস্ত্র বিক্রির তালিকায় ২ নম্বরে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে তাদের অস্ত্র বিক্রির হার ২১ শতাংশ। তৃতীয় ও চতুর্থ তালিকায় থাকা ফ্রান্স ও জার্মানি যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ এবং ৬ দশমিক ৪ শতাংশ অস্ত্রের বিক্রেতা। চীন পৃথিবীর ষষ্ঠ অস্ত্র বিক্রয়কারী দেশ, তারা গত পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮) পৃথিবীর বিক্রীত অস্ত্রের ৫ দশমিক ২ শতাংশের বিক্রেতা। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাদের গবেষণায় পরিষ্কার করে বলছে, বিশ্বের প্রধান অস্ত্রের জোগানদাতা ইউরোপ ও আমেরিকা।

বিশ্বে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, যুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ, শরণার্থী, জাতিগোষ্ঠী ইত্যাদি বিষয় দেখভালের জন্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকেই মানবাধিকারবিষয়ক ছয়টি সংগঠন রয়েছে। এসব সংস্থায় বিভিন্ন দেশের সদস্যরা থাকলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মুরব্বি ওই অস্ত্র বিক্রেতা দেশগুলোই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটেও এ ধরনের বেশ কিছু কমিটি রয়েছে। ইউরোপের নানা দেশে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল বা দেশভিত্তিক সংসদীয় কমিটি রয়েছে। এ ছাড়া তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলোতেও অঞ্চল বা দেশভিত্তিক ডেস্ক রয়েছে। সংসদীয় কমিটি ও অঞ্চলভিত্তিক ডেস্কগুলো বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নির্বাচন প্রভৃতি বিষয় পর্যবেক্ষণ করে এবং এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে থাকে।

এসবের বাইরে ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে শতাধিক বেসরকারি সংগঠন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক বৈষম্য, আইন ও অধিকার, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, জলবায়ু, শিশু ও নারী অধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা, শিক্ষা, স্বাবলম্বিতাবিষয়ক কাজ করছে। এসব বেসরকারি সংগঠন অনেক ক্ষেত্রেই সদস্যদের চাঁদা, অনুদান বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা সরকারি সাহায্য পেয়ে থাকে। এসব সংগঠনের অনেক সদস্য আবার স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকে। তারা বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোয় নানা ধরনের সেবা ও উন্নয়নমূলক কাজ করছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরোপীয় দেশগুলোর বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট বা ইউরোপ-আমেরিকার বেসরকারি সংগঠনগুলো একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা বা গবেষণা করে না। আর তা হলো ইউরোপ-আমেরিকার বিক্রীত ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র দিয়ে পৃথিবীর কত জনপদ ধ্বংস হয়েছে, কত সম্পদ নষ্ট হয়েছে এবং কত মানুষ গৃহহারা বা মৃত্যুবরণ করেছে। অসত্য ও ভুল যুক্তিকে সামনে এনে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার নামে কত দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে দিয়েছে।

একসময় ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও দখলদারি দিয়ে বিশ্ব পুঁজি লুণ্ঠন করেছে। তারা আজ মারণাস্ত্রের বড় কারবারি। তারাই আবার বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। তবে এসব পুঁজিবাদী দেশের জনগণের সবাই পুঁজিবাদের বাহক—এই বিশ্লেষণও সঠিক নয়। এসব দেশেও বহু সংগঠন ও বিশালসংখ্যক মানুষ আছেন, যাঁরা তাঁদের রাষ্ট্রগুলোর নানা মানবিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন। তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, বর্ণবাদ এবং বিশ্বের মানুষের অধিকার ও মানবিকতার জন্য লড়াই করছেন।

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি