প্রতিটি গ্রামে একটি করে সংরক্ষিত পুকুর

একটা সাধারণ ঘটনার দিকে আসুন আমরা চোখ ফেরাই। ট্রেনে বা লঞ্চে কোথাও যাচ্ছি। চলন্ত অবস্থায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে আমরা নির্বিকারভাবে যে টয়লেটে বর্জ্য ত্যাগ করছি, তা কোথায় গিয়ে পড়ছে? কখনো কি ভেবেছি এই বর্জ্য নদীর পানি বা রেললাইনের খোলা পরিবেশ দূষিত করছে? অথচ আমরা সবাই নদীদূষণ বন্ধ করতে চাই। স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে চাই।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬ অর্জনের জন্য আমরা বড় বড় পরিকল্পনা নিচ্ছি। সেখানে সবার জন্য নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজও করছি। যেমন নদীদূষণ বন্ধ করতে কলকারখানার বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় যেন নদীতে ফেলা না হয়, সে জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। সবাই যেন স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করে, সে জন্য গ্রামে গ্রামে কাজ করছি। এসবই প্রশংসিত হচ্ছে। অথচ দেশের ১৬ কোটি মানুষ চলাফেরার সময় কীভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে বর্জ্য ত্যাগ করবে, সেদিকে নজর নেই।

এটা একটা ছোট দৃষ্টান্ত, কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে বিষয়টি বড়। আমরা আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন পদ্ধতি যদি প্রবর্তন না করতে পারি, তাহলে কীভাবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলব? নদী, খাল–বিলগুলো আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে।

গত ২৭ মার্চ প্রথম আলো ও ওয়াটারএইড বাংলাদেশ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬ বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেখানে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জেনারেল ইকোনমিক ডিভিশনের সদস্য সিনিয়র সচিব শামসুল আলম অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি এই ছোট্ট বিষয় নিয়েও মন্তব্য করেন। এগুলো বন্ধ করার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এটা ঠিক যে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশ কয়েকটি অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে কাজ করছি। কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশ্বে, বিশেষভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে আছি। ২০৩০ সালের মধ্যে বেশ কিছু অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিচ্ছি। কিন্তু আরও অনেক কিছু না করলে যে পিছিয়ে পড়ব, সেদিকেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।

যেমন, আমরা দেশের প্রতিটি গ্রামে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের ব্যবস্থা করেছি। কিছু দুর্গম এলাকায় হয়তো অগ্রগতি কম। সেখানে চেষ্টা চলছে। আমরা এ ক্ষেত্রে এমনকি ভারতের চেয়েও এগিয়ে। নিরাপদ পানির ব্যবস্থাও গ্রামে গ্রামে রয়েছে। কিন্তু যেখানে পানিতে আর্সেনিক, সেখানে নিরাপদ খাওয়ার পানি সহজে পাওয়ার সমস্যা রয়েছে।

আগে গ্রামে খোলা স্থানে মানুষ বর্জ্য ত্যাগ করত। এখন গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই পাকা টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু টয়লেট–সংলগ্ন যে কুয়ায় বর্জ্য সংরক্ষণ করা হয়, নির্দিষ্ট সময় পর তা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে অপসারণের সুব্যবস্থা এখন করতে হবে। না হলে পরিবেশদূষণ বন্ধ করা যাবে না।

এখন বলা হচ্ছে, শুধু পাকা টয়লেট থাকাই যথেষ্ট নয়। সেই টয়লেট গড়ে কতজন ব্যবহার করছে, সে হিসাবও করতে হবে। সবাই স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করার সুযোগ গ্রহণ করছে কি না, সেটাও আমাদের হিসাবে আনতে হবে। আসলে এটা ঠিক যে সংখ্যা নয়, বাস্তব ব্যবহার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এটা লাইফ স্টাইল বা জীবনাচারের প্রশ্ন। জীবনাচারে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে না উঠলে সমস্যা থেকে যাবে। কিন্তু এখন আমরা বলতে পারি, সেটা এসে গেছে। পাকা টয়লেট ব্যবহারের বিষয়ে মানুষ বেশ সচেতন হয়েছে।

নিরাপদ পানির ক্ষেত্রে দেশে একটা বড় ধরনের বিপ্লব ঘটে গেছে। এমনকি অনেক গ্রামে মানুষ পরিশোধিত পানি পানের সুযোগ পাচ্ছে। পানির ফিল্টারের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। গ্রামের মানুষও এখন নিরাপদ পানি কিনে পান করে। এ বিষয়ে মানুষ এখন অনেক সচেতন।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। সে জন্য শামসুল আলম সাহেব চমৎকার একটি সুপারিশ করেছেন। প্রতিটি গ্রামে একটি করে পুকুর সংরক্ষণ করতে হবে। সেই পুকুরে কেউ মাছ চাষ করবে না, কেউ ময়লা ফেলবে না। সেটা হবে শুধু খাওয়ার পানির জন্য। বৃষ্টির পানি সেখানে জমা হবে। এর গুরুত্ব খুব বেশি। কারণ, উপকূলীয় অঞ্চলে পানির লবণাক্ততা বাড়ছে। তাই সংরক্ষিত পুকুরের পানি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ফিল্টার করে আমরা নিরাপদে পান করতে পারি।

এ ধরনের উদ্যোগ কিন্তু আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বেশ আগে থেকেই প্রচলিত। মনে পড়ে, ১০-১২ বছর আগে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানলে আমরা প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সাতক্ষীরার একেবারে উপকূলীয় অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণের কাজে যাই। তখন গ্রামবাসী অনুরোধ করে, খাওয়ার পানির জন্য একটি সংরক্ষিত পুকুর সংস্কারে যেন আমরা সহায়তা দিই। সেখানে একটি সংরক্ষিত পুকুর আগে থেকেই ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সেই পুকুর ভাসিয়ে দেয়। তাই মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছিল না।

আমরা সেই পুকুর সংস্কারে সহায়তা সেদিন দিই। পুকুরের সব পানি সেচে ফেলে দিয়ে আবার সুপেয় পানিতে ভরে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। এখনো সেই পুকুরের পানি এলাকার মানুষ নিয়মিত ব্যবহার করে।

তাই সব গ্রামে একটি করে পুকুর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে আমরা নিরাপদ পানির সুব্যবস্থা সহজে করতে পারব। এ রকম উদ্যোগ সফল হোক।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]