নির্জন কারাবাসের বিকল্প হাসপাতাল

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে আনা হয়েছে। এর আগেও তাঁকে একবার সেখানে এনে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আগে তিনি সেখানে চিকিৎসা নিতে অনিচ্ছুক থাকলেও সরকারি ভাষ্যমতে, এবার তিনি সেখানকার চিকিৎসায় রাজি হয়েছেন। তাঁর কারাজীবনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে গত ৮ ফেব্রুয়ারি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুর্নীতির মামলায় ২০১৮–এর ওই দিনে আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেওয়ার সময় থেকে তাঁর কারাজীবন কাটছে ঢাকার পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি ভবনে। এই কারাগার পরিত্যক্ত হয় তারও বছরখানেক আগে। সেই কারাগারের একটি অংশের একটি ভবনকে মেরামত ও বাসোপযোগী করার পর সেটিই হয়েছে খালেদা জিয়ার ঠিকানা। তিনিই সেখানকার একমাত্র বন্দী।

তাঁর সাজা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক যা–ই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত তিনিই প্রথম কোনো রাজনীতিক, যাঁর কারাজীবন কাটছে একঘরে হয়ে। এ ধরনের একঘরে বা অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বন্দীজীবন তাঁর এর আগেও কেটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও কেটেছে। তবে তাঁদের দুজনের সেই অতীত একাকিত্বের বন্দীজীবন ছিল বিচারাধীন আসামি হিসেবে, দণ্ডপ্রাপ্ত নয়। সেই বন্দিত্ব ছিল সংসদ ভবন এলাকায় সরকার–ঘোষিত বিশেষ উপকারাগারে।

রাজনীতিকদের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে যাঁরা জেল খেটেছেন—এমনকি সাবেক সেনাশাসক ও রাষ্ট্রপতি এরশাদও তাঁর সাজার সময়টা কেন্দ্রীয় কারাগারেই অন্যান্য বন্দীর মধ্যেই কাটিয়েছেন। তবে তাঁর জন্য কারাগারের ভেতরেই বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এঁদের কাউকেই একাকিত্বের দণ্ড ভোগ করতে হয়নি। দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার কারাবাস হচ্ছে অনেকটাই একাকিত্বের বা অন্য কথায় নির্জন কারাবাসের সমতুল্য। অবশ্য, আদালত বিশেষ বিবেচনায় ব্যক্তিগত দেখাশোনার জন্য তাঁর গৃহকর্মীকে কারাগারে তাঁর সঙ্গে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু গৃহকর্মী ফাতেমার বাইরে আর কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ বা নিয়মিত দেখা–সাক্ষাতের সুযোগ তাঁর নেই।

দণ্ডপ্রাপ্ত রাজনীতিকদের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত যিনি, সেই গোলাম আযমও তাঁর সাজার সময়টা কাটিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় হাসপাতালের প্রিজন ওয়ার্ডে, যেখানে সব সময়ই চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য বন্দীর পদচারণ ঘটে। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যেও অনেকে মাসের পর মাস হাসপাতালের প্রিজন ওয়ার্ডে কাটিয়েছেন বলে সংবাদপত্রের খবরে আমরা জেনেছি। এঁদের মধ্যে মাদক পাচারকারীও ছিলেন।

বিশ্বের আধুনিক কালের ইতিহাসে নির্জন কারাবাসের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন যিনি, তিনি হলেন বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের নেতা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা। দেশটির একটি জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপ, রবেন আইল্যান্ডের নির্জন কারাবাসে তাঁর জীবনের ২৭ বছর কেটেছে। ম্যান্ডেলার সেই স্মৃতিকে ধারণ করে ২০১৫ সালের মে মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ নির্জন কারাবাসকে নির্যাতন হিসেবে অভিহিত করে তা আইন করে নিষিদ্ধ করার জন্য সব দেশের প্রতি আহ্বান জানায়। নির্জন কারাবাসের প্রথা বিলোপসহ বন্দীদের মানবিক মর্যাদা প্রদান, চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা এবং কারাকর্মীদের জন্য পালনীয় নীতিমালার যে প্রস্তাবটি অনুমোদন করে, তা ম্যান্ডেলা রুলস নামে পরিচিত। ইউএন স্ট্যান্ডার্ড মিনিমাম রুলস ফর দ্য ট্রিটমেন্ট অব প্রিজনারস শিরোনামের এই নীতিমালায় নির্জন কারাবাসের সংজ্ঞাও দেওয়া আছে। ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী, দিনের ২২ ঘণ্টার বেশি যদি কাউকে অর্থপূর্ণ মানবিক যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে তা নির্জন বন্দিত্ব হিসেবে গণ্য হবে।

বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতৈক্য রয়েছে যে নির্জন কারাবাস বন্দীকে সামাজিক মেলামেশার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে বলে তা বন্দীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। তা ছাড়া, নির্জন কারাবাসে কর্তৃপক্ষ এবং কারাকর্মীদের জন্য সহজেই বন্দীর দৈহিক ও মানসিক ক্ষতিসাধনের সুযোগ থাকে বলেও মনে করা হয়। এসব কারণে বিচারাধীন অবস্থাতেও নির্জন কারাবাস যেন কখনোই ১৫ দিনের বেশি না হয়, আইনে সে ধরনের বিধান যুক্ত করার আহ্বানও ওই প্রস্তাবে রয়েছে।
কারাগারে সাধারণভাবে দিনের বেলায় বন্দীদের নিজেদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ থাকে। শুধু ফাঁসির আসামি এবং যাঁরা অন্যদের বিপদের কারণ হতে পারেন, এমন বিপজ্জনক ব্যক্তিদেরই অন্য বন্দীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। রাজনীতিকেরা তাঁদের কারাজীবনে বহু মানুষের সংসর্গে এসে নানা ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। বিভিন্ন রাজনীতিকের আত্মজীবনী থেকে এমন কথাও জানা যায় যে কারাগার থেকে পাওয়া তথ্য ও অভিজ্ঞতার আলোকে রাজনীতিকেরা পরবর্তী সময়ে দেশে নানা ধরনের আইন ও নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছেন।

গৃহকর্মী ফাতেমার কারণে খালেদা জিয়ার বর্তমান কারাজীবন আক্ষরিক অর্থে পুরোপুরি নির্জন কারাবাস নয়। কিন্তু কারাগারের ভেতরে সামাজিক সংযোগের স্বাভাবিক পরিবেশের নিরিখে নির্জন কারাবাসের সমতুল্য। বিষয়টি নিয়ে তাঁর পরিবার ও আইনজীবীদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ নজরে পড়ে না। তাঁর রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন সময়ে তাঁর মুক্তির দাবি করে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা এ কথাও বুঝতে পেরেছেন যে দলটির এখন যে দুরবস্থা, তাতে সরকার কোনো রাজনৈতিক চাপ অনুভব করছে না। নির্বাচনে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণার লক্ষ্য পূরণের পর তাঁর দলের নেতৃত্বহীন দুর্দশা স্বাভাবিকভাবেই আরও বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে কাবু করার লক্ষ্য সাধিত হওয়ায় এই রাজনৈতিক চাপ কমেছে।

খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাঁর জামিনে মুক্তি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা অবশ্য সাজার বিরুদ্ধে আপিলের কথা জানিয়েছেন এবং আপিল নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত তাঁর বাসাকে উপকারাগার ঘোষণা করে তাঁকে সেখানে থাকতে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া তাঁকে তাঁর পছন্দমতো হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু নির্জন কারাবাসের বিষয়ে দলটি কিংবা তাঁর আইনজীবীরা তেমন জোরালোভাবে কিছু বলেননি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীদের গড় আয়ু হচ্ছে ৭৩ দশমিক ৫ বছর। সেই হিসাবে যেকোনো সত্তরোর্ধ্ব নারীর এমনিতেই আলাদা সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন হতে পারে। খালেদা জিয়ার বয়সও ওই গড় আয়ুর কোঠা ছুঁয়েছে। সুতরাং, তাঁর যখন-তখন চিকিৎসাসেবার প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করা চলে? সেই বিবেচনায় হাসপাতালে তাঁর জন্য বিশেষ ব্যবস্থাই কি শ্রেয় নয়?

তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে পরিত্যক্ত কারাগারে তাঁর এই কার্যত নির্জন কারাবাসে কি একটি খারাপ নজির তৈরি হচ্ছে না? দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং একটি প্রধান দলের শীর্ষ নেত্রীর ক্ষেত্রে নির্জন কারাবাসই যদি স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে অন্যদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাঁকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করলে তাঁর সমর্থকেরা কিছুটা ক্ষুব্ধ হতে পারেন, এমন আশঙ্কাতেই হয়তো তাঁকে পুরোনো কারাগারে নেওয়া হয়। কিন্তু তাতে করে জনবিচ্ছিন্নতার মানসিক প্রভাবের যে বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে, অচিরেই তার অবসান ঘটানো উচিত এবং সে ক্ষেত্রে হাসপাতালই হতে পারে সবচেয়ে ভালো বিকল্প।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক