ছাত্রীর গায়ে আগুন লাগানো

বিচার এড়ানো সম্ভব বা শাস্তি পেতে হবে না, এমন বিশ্বাসজাত অভয় থেকে যেসব গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে, সেগুলোর অন্যতম প্রধান শিকার নারী। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ নানা ধরনের সহিংস অপরাধের শিকার হয়েও এ দেশের অধিকাংশ নারী ন্যায়বিচার পান না। শুধু তা-ই নয়, অপরাধের শিকার নারীর ন্যায়বিচার চাওয়াও বিপজ্জনক। অপরাধীর শাস্তির দাবিতে মামলা করলে সেই বিপদ যে প্রাণঘাতী রূপ ধারণ করতে পারে, তার সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত ফেনীর সোনাগাজীর একটি মাদ্রাসার এক ছাত্রীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা।

শনিবার সকালে মাদ্রাসায় পরীক্ষা দিতে গিয়ে ওই ছাত্রী যে রোমহর্ষক বর্বরতার শিকার হয়েছেন, তার কিছু বিবরণ গতকাল রোববার প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে তাঁর এক বান্ধবীকে মারধর করা হচ্ছে—এ কথা বলে ওই ছাত্রীকে ছাদে ডেকে নিয়ে মুখোশ পরা চার-পাঁচ তরুণী তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। ফলে তাঁর শরীরের ৭৫ শতাংশ পুড়ে যায়। এই সম্পাদকীয় লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।

ছাত্রীটিকে দৃশ্যত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে এই কারণে যে তিনি তাঁর মাদ্রাসার অধ্যক্ষের দ্বারা যৌন পীড়নের শিকার হয়ে বিচার চেয়েছেন। তাঁর পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী গত ২৭ মার্চ সোনাগাজীর ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদদৌলা তাঁকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। এই অপরাধের আইনি প্রতিকার চাইতে তাঁর মা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন। অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু তাঁর পক্ষে কিছু লোক মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ওই ছাত্রীর পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছিল। মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি রুহুল আমিন, যিনি সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। ওই ছাত্রীর ভাই অভিযোগ করেছেন, সোনাগাজীর ওই মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শুক্রবার রাতে ফোন করে হুমকি দেন, মামলা নিয়ে আর এগোলে মেরে ফেলা হবে। ফেনী জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির দাবি করেছেন, অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা একসময় জামায়াতের রোকন ছিলেন, ২০১৬ সালে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অর্থাৎ নারী নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের সাবেক রোকন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মদদ পাচ্ছেন।

ছাত্রীটি যে তাঁর অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তোলার কারণেই আগুন–সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন, তা তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন। যাঁরা তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা তাঁকে মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে বলেছেন, তিনি ‘প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে মামলা’ দিয়েছেন কেন? তিনি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছেন, সেটাকে মিথ্যা বলার জন্য তাঁরা ওই ছাত্রীকে চাপ দিয়েছেন এবং ওই ছাত্রী তাঁদের চাপের মুখে নতিস্বীকার করেননি বলে তাঁরা তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা ছাত্রীটিকে পুড়িয়ে মারার উদ্দেশ্যে মাদ্রাসার ছাদে কেরোসিন নিয়ে গেছেন। এমন পরিকল্পিত নিষ্ঠুরতা সত্যিই বিস্ময়কর। এই মুহূর্তে তাঁদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।

সোনাগাজীর ওই মাদ্রাসাছাত্রীর ওপর অপরাধ করা হয়েছে দুই দফায়। তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য কারারুদ্ধ অধ্যক্ষই যে দায়ী, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সোনাগাজী থানার ওসি বলেছেন, পুলিশ শনিবারের ঘটনাটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। আমরা বলতে চাই, অপরাধের শিকার এক ছাত্রী ন্যায়বিচার চেয়ে আরও গুরুতর অপরাধের শিকার হয়েছেন। এর সুষ্ঠু বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।