পোড়াবেন নাকি পুড়বেন?

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাদ্রাসাছাত্রী। ঢাকা মেডিকেল, ০৬ এপ্রিল। ছবি: আহমেদ জায়িফ
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাদ্রাসাছাত্রী। ঢাকা মেডিকেল, ০৬ এপ্রিল। ছবি: আহমেদ জায়িফ

কখনো গরম চা বা কফি খেতে গিয়ে জিব পুড়িয়েছেন? চা–কফি খেতে গিয়ে একবারও জিব পোড়েনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ওইভাবে পোড়ার পর জিবে খুব জ্বালা হয়। অন্য কোনো খাবার খেতে গেলেই জ্বালা বাড়ে। সেই জ্বালা দুই–তিন দিনের আগে কমে না। এবার মনে করুন ফেনীতে দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে যাওয়া ছাত্রীটির কথা। তাঁর জ্বালা টের পাচ্ছেন?

গত শনিবার ফেনীর সোনাগাজীর একটি মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে মেয়েটিকে ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর অপরাধ, তিনি অধ্যক্ষের অশালীন ব্যবহারের বিচার চেয়েছিলেন। গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিশু ও নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছিলেন মেয়েটির মা। অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। এর পরই শুরু হয় হুমকি–ধমকি। মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় ছাত্রীটির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

হামলার দিনই গুরুতর আহত অবস্থায় ওই মাদ্রাসাছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সংকটজনক অবস্থায় আছে মেয়েটি। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাঁর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু মাদ্রাসাছাত্রীর ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ থাকায় তাঁকে এখনই সিঙ্গাপুরে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শে মেয়েটির একটি অস্ত্রোপচারও করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষত এতটাই যে, ঝুঁকি কমছে না। দেশের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অগ্নিদগ্ধ মেয়েটির বুক-পিঠ পুড়ে এমনভাবে ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে যে ফুসফুস ওঠানামা করতে পারছে না। অস্ত্রোপচারের পরিকল্পনা এ জন্যই, যেন ফুসফুসটা ঠিকমতো কাজ করতে পারে।

মেয়েটি ও তাঁর পরিবারের অভিযোগ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এই হামলা চালানোর পেছনে মূল অনুঘটক হচ্ছে মামলা। অভিযুক্ত অধ্যক্ষ দোষী নাকি নির্দোষ—সেটি আদালতের বিবেচনাধীন বিষয়। আদালতে বিচার শুরুর আগেই যখন অভিযুক্ত পক্ষ মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দেয়, তখন ধরে নিতেই হবে যে, ‘অপরাধ’ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। রাষ্ট্র বা সমাজের চোখে ‘স্বীকৃত অপরাধী’ না হতেই এই কাজ করা হয়। ধরুন, আপনার সন্তান ঘরের কোনো দামি জিনিস নষ্ট করে ফেলল। সে কিন্তু শুরুতেই তা লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করবে। কারণ সে জানে যে, দোষ করেছে। অপরাধ লুকিয়ে ফেলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রীর ঘটনাটিতেও সেটিই হয়েছে।

মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছে তাঁর পরীক্ষার কেন্দ্রে, খুব পরিকল্পিতভাবে। ফেনীর সোনাগাজীর অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী লাইফ সাপোর্টের যাওয়ার আগে চিকিৎসকদের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন গত রোববার। তিনি তাঁর বক্ত‌ব্যে বলেছেন, নেকাব, বোরকা ও হাত মোজা প‌রি‌হিত চারজন তাঁর গা‌য়ে আগুন ধ‌রি‌য়ে দেন। জবানবন্দি থেকে বোঝা গেছে, হামলাকারীদের অন্তত দুজন নারী ছিলেন। অর্থাৎ নারী নির্যাতনের মামলা তুলে নিতে হামলা করেছেন নারীরাই, তাঁরা গায়ে আগুন ধরিয়ে জীবনও নিয়ে নিতে চাইছেন! অবশ্য কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে থাকতে থাকতে নারীদের একটি অংশও একসময় পুরুষতন্ত্রের ধারক–বাহক হয়ে উঠতে পারে। অন্তত এ–সংক্রান্ত তাত্ত্বিক আলোচনা তেমনই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, নারীরা আর কতকাল নির্যাতন সহ্য করবেন এবং নিপীড়কের সহকারী হবেন? যাঁরা আগুন ধরিয়েছিলেন, তাঁরা কি একবারও ভেবেছেন যে, ওই মেয়েটির জায়গায় তাঁদের পরিবারের কেউ থাকলে কী করতেন? মেয়েটির অভিযোগ, ক‌য়েক বছর ধ‌রেই মাদ্রাসার ওই অধ্যক্ষ নারী শিক্ষার্থী‌দের হয়রা‌নি ক‌রে আস‌ছেন। পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দেওয়ার প্রলোভন দেখা‌তেন তিনি। তাঁর কথায় রা‌জি না হ‌লে হেনস্তা ক‌রতেন। একজন শিক্ষার্থী যখন নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন যৌন নিপীড়নের শিকার হন, তখন তাঁর মনের ভেতরে ঝড় বয়ে যায়। হামলাকারীদের পরিবারে কোনো নারী নেই—এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু তাঁরা ওই মেয়েটির শরীরে আগুন ধরানোর আগে একটিবারও নিজের মা–স্ত্রী বা মেয়েদের কথা ভাবেননি। ভাবলে নিশ্চয়ই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলত না।

‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ টি-শার্ট গায়ে দুজন নারী। ছবি: সংগৃহীত
‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ টি-শার্ট গায়ে দুজন নারী। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের দেশের মানুষ কথাপ্রিয়। আমরা অনর্গল কথা বলতে বেশ ভালোবাসি। কিছু করে দেখানোয় আমাদের আগ্রহ কম। ফেসবুকের মতো ভার্চ্যুয়াল জগৎ তৈরি হওয়াতে আমাদের আরও ভালো হয়েছে। যেকোনো বিষয়ে দু–লাইন লিখেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করা চেষ্টা করি আমরা। এরপর সেই কথা নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে লড়াই শুরু করি। সবটাই ঘরে বসে হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু করে দেখানোর বিষয়টি মাথায় আনতেও আমাদের আলসেমি। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রীর ওপর হামলার ঘটনাতেও তেমনটিই হয়েছে। কেউ কেউ এর মধ্যেও পোশাকের প্রসঙ্গ তুলতে চাইছেন। নারী নিপীড়নের যেকোনো ঘটনায় পোশাকের বিষয়টি অবধারিতভাবে তুলে ধরেন এ দেশের অনেক পুরুষ। তাঁদের কথায় মনে হয়, পোশাকেই সব বিপত্তি! অথচ নিজেদের ভেতরের পশুটাকে মেরে ফেলার কথা কেউ বলেন না। আচ্ছা, বলুন তো, পোশাকই যদি কারণ হবে, তবে ফরিদপুরে আড়াই বছর বয়সী শিশু কেন ধর্ষণের শিকার হবে?

এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’। এই লেখাসংবলিত টি–শার্ট ও খোঁপার কাঁটা অনেক পুরুষেরই হৃদয়ে কাঁটা হয়ে বিঁধেছে। উদ্যোক্তা বলেই দিয়েছেন, এর মূল উদ্দেশ্য ব্যবসা নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই সচেতনতামূলক এ কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের ‘মিনি পৃথিবী’ (পড়ুন ফেসবুক) সরগরম। কেউ সরাসরি বিরোধিতা করে নিজের জাত চেনাচ্ছেন, আবার কেউ মিনমিনে গলায় বলছেন ‘স্টান্টবাজি’। অর্থাৎ নারীদের যেকোনো নিরীহ বিদ্রোহও আমাদের দেশের অনেক পুরুষের গাত্রদাহ সৃষ্টি করে। সেই জ্বালা এতটাই যে, অশ্রাব্য কথা বলতেও আমাদের বাধে না। তখন অবশ্য আমরা ভুলে থাকি যে, ‘মেয়েরা মায়ের জাত’! বরং পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠি আমরা।

ইংরেজিতে ইউটোপিয়া ও ডিসটোপিয়া বলে দুটো শব্দ আছে। দুটি শব্দই কাল্পনিক দৃশ্যপটের বর্ণনা দেয়। ইউটোপিয়া হলো এমন একটি কাল্পনিক সমাজ, যেখানে খারাপ বলতে কিছু নেই, সব ভালো। আর ডিসটোপিয়া ঠিক উল্টোটা বোঝায়। অর্থাৎ ওই কাল্পনিক সমাজের সবই খারাপ, সর্বত্রই অন্যায়–অবিচার। ইউটোপিয়া না হোক, অন্তত ডিসটোপিয়ার উদাহরণ হওয়া আমাদের কাম্য নয়। এ জন্য মনের আয়নায় নিজেদের স্বরূপ চেনা খুব জরুরি, ত্রুটি থাকলে অনুশোচনার আগুনে পোড়া প্রয়োজন। তা না হলে, বহিরঙ্গে মানুষ থাকলেও, ভেতরটা পাশবিকই রয়ে যাবে।

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
[email protected]