স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় হোক

ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনভার নিজদের হাতে তুলে নেওয়ার আগেই এ দেশে আধুনিক ধারায় স্থানীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়। ১৭৯৪ সালে সীমিত ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত হয় কলকাতা করপোরেশন। তবে সারা দেশে এ ধরনের স্থানীয় শাসন চালু হয় ১৯ শতকের শেষ দিক থেকে। বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলায় জেলা বোর্ড, মিউনিসিপ্যালটি ও ইউনিয়ন বোর্ড নামে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চালু ছিল। আইয়ুব খান পাকিস্তানের শাসনভার নেওয়ার পর থানা পরিষদ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু হয়। যেহেতু এসব স্তরে কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল, তাই ছিল রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল। অবশ্য দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়া হতো না। ক্ষেত্রবিশেষে দলীয় নেতা-কর্মীরা কারও পক্ষ নিয়ে প্রচার-প্রচারণার কাজ চালাতেন। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা এমনকি সিটি করপোরেশনে ছিল না দলীয় প্রতীক দেওয়ার ব্যবস্থা।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য, পৌরসভার মেয়র ও কমিশনার এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের স্থানীয় পর্যায়ের জনগণের সঙ্গে ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা থাকে। এ ক্ষেত্রে ভোটাররা সাধারণত বিবেচনায় নেন প্রার্থীকে, দলকে নয়। এ বিবেচনার ভিত্তি জনগণের সঙ্গে প্রার্থীর সম্পর্ক, জনসেবার ঐতিহ্য, পারিবারিক সম্পর্ক প্রভৃতি। দলীয় পরিচয়ও ক্ষেত্রবিশেষে বিবেচনায় থাকে। ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়রদের কেউ কেউ ভিন্ন দল-মতের হলেও সরকারের উন্নয়ন কাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেন। কয়েক বছর আগ পর্যন্ত ব্যবস্থাটি কার্যকরভাবেই চলছিল। হঠাৎ আইন পাল্টে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও পৌরসভার কমিশনার ছাড়া স্থানীয় সরকারের সব স্তরের পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। কিছুদিন এভাবে চলল। সময় এসেছে এটা মূল্যায়নের।

দলীয় প্রতীকে এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে। সে সুযোগ কাজেও লাগানো হয়। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। সরকারি দলের প্রার্থীরাই একতরফা জয়লাভ করেন। এমন অবস্থায় বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করে। তাই ভোটারের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যায়। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন একজন নির্বাচন কমিশনারও। অবশ্য নির্বাচন কমিশন ভোটার আনার কাজ করে না। তবে ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আনার পরিবেশ নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। এর মধ্যে রয়েছে ভোটারের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ। শতাধিক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে এমনটি হওয়ার কথা নয়।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলে কোনো দলের নির্বাচন বর্জনের সুযোগ ছিল না। অভাব হতো না প্রার্থীর। সে ধরনের অংশগ্রহণমূলক নির্দলীয় নির্বাচনে কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকতেন ভোটাররা। প্রার্থীরা ছুটতেন তাঁদের দ্বারে দ্বারে। এভাবে নির্বাচিত হওয়া জনপ্রতিনিধিরা অধিক দায়বদ্ধ থাকতেন জনগণের কাছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের অবস্থান আজ বিপরীতমুখী। এ অবস্থা থেকে ফেরার পদক্ষেপ বিভিন্নভাবে নিতে হবে। সূচনাটা হতে পারে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা দিয়েই। এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের ফলাফলে জাতীয় সরকারে কোনো প্রভাব নেই। দলীয় পরিচয়হীন নির্বাচন হলে এর ছিটেফোঁটাও থাকবে না। তাই ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদসহ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকের বাইরে আনা প্রয়োজন। এবার গোপালগঞ্জের পাঁচটি উপজেলা পরিষদে সরকারি দল কোনো মনোনয়ন দেয়নি। উন্মুক্ত রেখেছে।

এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আরেকটি উপসর্গ লক্ষণীয়। সরকারি দলের প্রার্থীরা পান নৌকা প্রতীক। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীসহ নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছেন ৩০৪ জন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন ১৩৬ জন, তাঁরা মূলত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৫ জন সাংসদ বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা বা সমর্থন দিয়েছেন। অন্য একটি বাংলা দৈনিকের মতে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে সরকারি দলের বেশ তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। মনোনয়ন দিতে, বিদ্রোহীদের বশে আনতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে। তা-ও সব ক্ষেত্রে সফল হয়নি। ভোটারদেরও নির্বাচনমুখী করা যায়নি অনেক ক্ষেত্রেই। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে দলের। নৌকা প্রতীকের বিপরীতে অনেক ক্ষেত্রেই দলের নেতা-কর্মীদের অবস্থান। যে কথাটি এখন আলোচনায় নেই, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়া হয় জেলা পর্যায় থেকে। সেখানে বড় অঙ্কের মনোনয়ন-বাণিজ্য হয়েছে বলে ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। এর মাশুল দেবে জনগণ। স্থানীয় পর্যায়ের কাজকর্মের গুণগত মানে আপস করেই এ টাকা আদায় হবে। অবশ্য সজ্জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন অনেকেই। তাঁরা বড় জনগোষ্ঠীর কল্যাণেই কাজ করতে চান। তবে দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ায় দলের নেতা-কর্মীদের আওতার বাইরে যেতে পারছেন না। তাঁদের একটি অংশ ক্ষেত্রমতো এসব অন্যায্য সুবিধার অংশীদার বনে গেছেন। এ গাঁটছড়া ভাঙার একটি পথ হতে পারে স্থানীয় পর্যায়ের সব নির্বাচনকে দলীয় প্রতীকের আওতামুক্ত করা।

গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। জনমত গঠনসহ তৃণমূল পর্যায় থেকে জনগণের চাহিদা দলের জাতীয় পর্যায়ে জ্ঞাত করানোর দায়িত্ব তৃণমূলের নেতা-কর্মীদেরই। ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন দলীয় প্রতীকেই হয়। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে হিংসাশ্রয়ী দলাদলি চলছে। প্রাণহানি ঘটে প্রায়ই। গ্রামীণ জনগণের উন্নয়ন সূচকে কিছু ক্ষেত্রে তারা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। আমাদের সুবিধার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্দলীয় রূপ অনেকটা এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলেই কোনো কোনো গবেষক মনে করেন। দলীয় প্রতীক এনে এখানে তেমন ভালো হয়নি বলেও সুশীল সমাজের একটি অংশ বিশ্বাস করে। হতে পারে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়রদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচিতি রয়েছে। সংশ্লিষ্টতা তো কিছু পরিমাণে থাকবেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সুসংহত নয়। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের পর সরকারি দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আরও বেপরোয়া। জনগণ কিংবা ভোটার এখন নির্বাচনব্যবস্থার প্রধান নিয়ামক নয়, এমনটাই ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। তাই তারা ভোটকেন্দ্রমুখী হতে চান না। স্থানীয় পর্যায়েও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে কিংবা দলীয় প্রতীক না দেওয়া হলে, প্রার্থী ও ভোটারের অভাব হতো না। বরং জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় পর্যায়ে ভোটারের উপস্থিতি বেশি থাকে, এমনটাই আমাদের অভিজ্ঞতা।

কোনো নিয়ম করা হলে তা সংশোধন করা যাবে না, এমন কথা নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করার সুফল কতটুকু হয়েছে, এখন হয়তো সরকার কিছুটা বুঝতে পারছে। কারা এ ব্যবস্থার উপকারভোগী, এটাও বলার আবশ্যকতা নেই। তবে জনসাধারণ যে ভোগী নয়, এটা বলা বাহুল্য। সৌভাগ্য, পেছনে ফেরার রাস্তা তো বন্ধ নয়। এ নিয়ে কেউ কোনো বিরূপ সমালোচনা করবে, এমনটাও মনে হয় না। তাহলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগের মতোই নির্দলীয় করতে দোষ কোথাও নেই।

নির্বাচন অবশ্যই একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তাই বলে সব স্তরেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হতে হবে, এমনটা আবশ্যক নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো হলো। বিচক্ষণতা থেকেই গোপালগঞ্জের পাঁচটি উপজেলা পরিষদকে সরকারি দল প্রার্থী মনোনয়ন না দিয়ে উন্মুক্ত রেখেছে। তেমনটা রাখা দরকার সব স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]