নুসরাতের অভিশাপের আগুন বনাম সতেরো কোটির ঘুম

আমরা যেদিন আগুনের নদী থেকে
তুলে আনলাম মা-র ভেসে যাওয়া দেহ
সারা গা জ্বলছে, বোন তোর মনে আছে
প্রতিবেশীদের চোখে ছিল সন্দেহ?

সৎকার গাথা/জয় গোস্বামী

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান

চীনা ক্যালেন্ডারে কোনো বছর ড্রাগনের, কোনো বছর অন্য কোনো প্রাণীর নামে। আমাদের বছর না, মাসও না। দিনগুলোর কোনোটি আগুনের, কোনোটি সড়কে মৃত্যুর, কোনোটি লেখক হত্যাকাণ্ডের, কোনোটি গলাকাটা খুনির, কোনোটি চাপাতি-হাতুড়ির, কোনোটি লাগাতার ধর্ষণের। ঘটনার পর ঘটনা আছড়ে পড়ে, আমরা সাঁতার না-জানা মানুষের মতো এলোমেলো হাত-পা ছোড়া প্রতিবাদ করে আবার তলিয়ে যাই। আমাদের বিপর্যয়ের ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি দিন ইয়াসমিনের মুখ, অন্য দিনগুলি  নুরজাহান, নারায়ণগঞ্জের কিশোর কবি ত্বকীর বা সাগর-রুনির। এভাবে তনু-আফসানা-সুবর্ণচর-অরিত্রী-মীম-বিউটি হয়ে আমাদের সময়ের নাম এখন নুসরাত। এখন মৃত্যুশয্যায় থাকা পোড়া জীবনের পোড়া বুক থেকে উঠে আসা শেষ উচ্চারণ: ‘আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাব শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত…আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব, সারা পৃথিবীর কাছে বলব এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য…।’

মেয়েটি তা-ই করে গেছে। জীবনটা তার প্রতিবাদ, মৃত্যুও তার শ্রেষ্ঠতম প্রতিবাদ। প্রতিবাদ করে করেই এগোতে চেয়েছে নুসরাত। যখন তাকে উত্ত্যক্ত করেছিল বখাটেরা, তখনো সে প্রতিবাদ করেছিল। সে খবর গণমাধ্যমে চাউরও হয়েছিল। এখন যখন তারই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তাকে লাঞ্ছিত করতে চেয়েছে, তখনো তিনি প্রতিবাদ করেছে। যখন তার শরীরের ৮০ ভাগ পুড়ে গেছে, যখন তার বাঁচার আশা সামান্য, তখনো তার যন্ত্রণার গহ্বর থেকে উচ্চারিত হয়েছে, ‘আমি সারা পৃথিবীর কাছে বলব…’। পৃথিবী, ও নিষ্ঠুর সীমারের পৃথিবী, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ তোমার কন্যার ডাক?

মানুষের দেশ হলে এমন সাহস ও টনটনে আত্মসম্মান যার তেমন মেয়েকে মাথায় করে রাখত, নিজের মেয়েদের বলত, ‘তোমরা নুসরাতের মতো হয়ো’। আমরা তা বলতে পারব না এই খুন-ধর্ষণের হুমকি-তাড়িত দেশে। আমরা বলব সয়ে যাও, আমরা বলব গুটাতে গুটাতে কেঁচোর মতো গোল হয়ে গর্তে ঢুকে পড়ো, মাথা তুলো না।

হলিউডের ‘অ্যাভেঞ্জার’ ছবিতে সব সুপারহিরো একসঙ্গে নেমে পড়ে দুনিয়াকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে। আমাদের দুরবস্থাটা হলো এই: দেশটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে একযোগে নেমে পড়েছে সব দস্যু, বর্বর, খুনি, ধর্ষক, আগুনবাজ, বিচারবিনাশী শক্তিরা। টেলিভিশন নিজেই অবাক হয়: এত এত নৃশংসতা, গা ছমছম করা, অসহ্য আঘাতও নির্বিকার দর্শকের মতো দেখে যাচ্ছ তোমরা?

শরীরের কোনো জায়গায় বারবার আঘাত পেলে সেই জায়গার চামড়া কড়া পড়ে মোটা হয়ে যায়, অনুভূতি আর কাজ করে না। আমাদের সেটাই হয়েছে। মার খেতে খেতে, পরিবর্তনের আশা ছেড়ে দিতে দিতে আমরা নিজেরাই বদলে গিয়ে হয়েছি সর্বংসহা জীব। যতই আমরা পরিবর্তন আর প্রতিকারের জেদ ছেড়েছি, ততই সমাজটা হয়ে গেছে দানবীয় ক্ষমতার অভয়ারণ্য।

অন্য দেশে জনগণ বাস্তবতা বদলায়, সিস্টেমের সংস্কার করে। আর আমরা দেশবাসী যখন সিস্টেম নড়াতে পারছি না, তখন ওই সিস্টেমই জনগণকে বদলে দিচ্ছে। প্রতিটি অন্যায়ের ঘটনা থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে তিনটি সর্বনাশা তির: একজন শিকার হয়ে পড়ে যাচ্ছে আর উঠে দাঁড়াচ্ছে নতুন এক অপরাধী, সৃষ্টি হচ্ছে নির্বিচার অপরাধের বিচারহীনতার অভ্যাস। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, আমাদের সয়ে যাওয়ার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।

মুরগির খোঁয়াড় থেকে যেমন মুরগির ধরে ধরে সাবাড় করা হয়, তার আগে পর্যন্ত তারা দিব্যি দানাপানি খায়, কোককোরো কো বলে ডাকে, আমরাও তেমনি শিকার হওয়ার আগে পর্যন্ত চলি–ফিরি, গান গাই, উহ-আহ করি। তারপর মরে গেলেই সব শেষ। হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস। যেন অপেক্ষা করে আছি দেখতে যে মৃত্যুর নায়েব তার লটারিতে আজ তুলল কার নাম! যদি দেখি আজ আমি নেই, তো আরেকটি দিন পাওয়ার আনন্দে যে পড়ে গেল, ধ্বংস হলো, তার নামটাই ভুলে যাই। ভুলে গেছি না? ভুলে তো যাচ্ছিই, আমাদের সময় কত কত তরুণ প্রাণের নামে লেখা। সনি, তনু, ফারহানা, রুনি, নুসরাত আর মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো মৃত্যু আর এক শীতলক্ষ্যাপাড়ের ত্বকী!

কোনো কোনো প্রাণী নিজের ক্ষত-ঘা লেহন করে। আমরা বোধ হয় আমাদের অন্যায় ও মিথ্যাকে লেহন করার জায়গায় চলে এসেছি। আমাদের সিস্টেমের গায়ে ঘা। এই সিস্টেম ক্ষত করছে, রক্ত ঝরাচ্ছে আমাদের শরীরে। আমাদের সুবিধায় ভোগা মানুষেরা সারাবার বদলে নিজ নিজ ঘা চাটছি, আর আমাদের ভুক্তভোগীরা চেটে পরিষ্কার করতে চাইছি নিজ নিজ ক্ষত থেকে ঝরা রক্ত।

সুশাসনের ও নাগরিকের শক্তি নিস্তেজ হওয়ায় যাবতীয় দুর্বৃত্তরা ভেসে উঠেছে ঘোলা পানিতে, আর বিষ্মরণের চাবুক খেয়ে খেয়ে ভুলে যাচ্ছে ভালো মানুষেরা। ঘোলা পানিতে ভেদা মাছ ভেসে উঠে দম নেয়, ওই মাছটা অন্য মাছের খাদক বিধায় ছোট ছোট মাছ তলায় চলে যায়, সেখানে তখন ঘোলা পানিতে অক্সিজেন কমে আসে। তারা তখন বাধ্য হয় ভেসে উঠতে। আর তখনই পড়ে শিকারির খপ্পরে, হয় বড় মাছ তাদের খায়, নয়তো জেলেরা তাদের ধরে।

বাঁচার উপায় কী? প্রথম কথা হলো সুশাসন। সেটা করবে সরকার। কোনো নাগরিকই যাতে অরক্ষিত না থাকে, তার বন্দোবস্ত পাকা করতে বাধ্য করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো বিচার। বিচার করবেন আদালত, তদন্ত করবে প্রশাসন। প্রশাসন যাতে নিরপেক্ষ তদন্ত করে, তাদের দিয়ে যাতে তা করিয়ে নেওয়া যায়, তার জন্য ব্যাপক-বিস্তর নাগরিক ও সাংবাদিক নজরদারি জরুরি। আইনকেও পাহারা দিতে হয়, তা তো আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝছি। আইন যাতে সঠিক বিচারটা করে, সেই পরিবেশ তৈরিতে আপস করা যাবে না।

কিন্তু সরকার একা পারবে না। অন্যায়-হিংসা-লোভ যতক্ষণ বাইরে থাকে, সামাল দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটা শরীর-মনের অংশ হয়ে গেলে তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কিন্তু সেটাই যখন সমাজ-রাষ্ট্রের ভেতরের শক্তি হয়ে যায়, তখন সিস্টেম আর নিজেকে সারাতে পারে না। ফেনীর নিপীড়ক শিক্ষকটি জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ঠাঁই পেয়েছে সরকারি দলে। এটাই বোঝায়, অপরাধী যে দলেরই হোক, ক্ষমতাই তার আশ্রয়। তাই এত কিছুর পরও নুসরাতের পরিবারকে আপস করতে হুমকি দেওয়া হয়, এত কিছুর পরও পাষণ্ড লোকটার ক্ষমতার খুঁটি অটুট থাকে। শুধু ব্যক্তি অপরাধীর বিচারে তাই শান্তি আসবে না। দায়ী ক্ষমতাতন্ত্রের বিহিত করতেই হবে। এমন বাস্তবতাতেই কিশোর-কিশোরীদের আন্দোলনের দাবি হয়ে ওঠে ‘রাষ্ট্র মেরামত’-এর। মেরামত সমাজেও করতে হবে। প্রতিটি পরিবার যদি তার ভেতরে কোনো অমানুষকে জায়গা না দেয়, সমাজের যতটুকু জোর আছে, নৈতিক পোড়ানি আছে, তা জড়ো করে যদি তারা অপরাধীদের বর্জন করে, তাহলে সুনীতি ও ভালো মানুষেরা একটু জায়গা পাবে, ভরসা পাবে।

সুবিচার চাইলেন বাবা এ কে এম মুসা। ছবি: আসাদুজ্জামান।
সুবিচার চাইলেন বাবা এ কে এম মুসা। ছবি: আসাদুজ্জামান।

যৌন নির্যাতন ও নারীর বিরুদ্ধে হিংসার বেলায় যৌনায়িত পাবলিক কালচারের দায়টাও দেখতে হবে। আমলে নিতে হবে নির্বিচার ভোগের সংস্কৃতিকেও। আনন্দ-বিনোদনের নামে দিনরাত মোবাইল থেকে টেলিভিশন, ইউটিউব থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে যে রগরগে পুরুষালি ভোগ–বাসনা মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাও চলবে আর নারীর নিরাপত্তাও থাকবে, তা হয় না। জোর করে ক্ষমতা, সম্পদ ও নারী এবং দুর্বল মানুষদের ভোগ/অত্যাচার করা যায়, এই তরিকা সামাজিক ডিএনএ বদলে দিয়েছে। সেখানে বদলের জাগরণ ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না।

নুসরাতই প্রথম নন, এখানেই এই হাজার রজনীর অন্ধকার দূর হবে না। এই দেশ এখন সড়কে থেকে স্কুলে, ঘরে ও বাইরে সবভাবে শিশু-কিশোর ও নারীদের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। যখন সবচেয়ে নাজুক অংশটা, ভবিষ্যতের আশাগুলো সবচেয়ে বিপন্ন থাকে, তার থেকে সর্বনিম্ন দশা আর হয় না। সামাজিক জড়তা বা Social inertia আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। অন্যদিকে, অতি অ্যাকটিভ কুরিপু–তাড়িত লোকেরা, তারা সংগঠিত, তারা দুর্ধর্ষ। তারা আমাদের গা ঘেঁষেই দাড়িয়ে আছে। 

সারা দেহে ব্যান্ডেজ বাঁধা নুসরাতের নিদাগ মুখের অভিশাপ যাদের পাওনা, তাদের গায়ে লাগুক। তাদের সবার বিচার হোক।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও কবি

আরও পড়ুন...