ঋণ মওকুফের বিনিময়ে অ্যাসাঞ্জকে 'কিনে' নিল যুক্তরাষ্ট্র?

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করেছে লন্ডনের পুলিশ। ১১ এপ্রিল, যুক্তরাজ্য। ছবি: রয়টার্স
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করেছে লন্ডনের পুলিশ। ১১ এপ্রিল, যুক্তরাজ্য। ছবি: রয়টার্স

উইকিলিকসের কথাই সত্য হলো। ৪ এপ্রিল উইকিলিকস তাদের প্রতিষ্ঠাতার গ্রেপ্তারের ব্যাপারে শঙ্কার কথা জানিয়েছিল টুইটারে। বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলো এই শঙ্কার কথা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিল তখন। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে তা সত্য হলো। লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসের আশ্রয় থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ১১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। উইকিলিকস ও অ্যাসাঞ্জের আইনজীবী তথ্যপ্রমাণ হাজির করেই দাবি করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধেই এই গ্রেপ্তারপর্ব এবং চূড়ান্তভাবে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই তুলে দেওয়া হবে।

৪৭ বছর বয়সী অ্যাসাঞ্জ সাত বছর ধরে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসেই আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। ব্রিটেনে গ্রেপ্তার এড়াতে ইকুয়েডরের পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেরার আগ্রহেই সেখানে তিনি আশ্রয় পান। কোরেরা তাঁর ক্ষমতাসীন থাকার শেষ দিন পর্যন্ত ব্রিটেনকে অনুরোধ জানিয়ে গিয়েছিলেন অ্যাসাঞ্জকে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী’ হিসেবে বিবেচনা করে কূটনৈতিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য। কিন্তু ব্রিটেন তা করেনি। কারণ, কূটনৈতিক মর্যাদা পেলেই অ্যাসাঞ্জ নিরাপত্তার খাতিরে রাশিয়ায় পালাতেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল। তাই নিজেদের হাতে পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অ্যাসাঞ্জকে লন্ডনেই রাখতে আগ্রহী ছিল তারা।

আপাতত ব্রিটেন অ্যাসাঞ্জকে তুলে নিয়ে গেলেও ইতিমধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বব্যাপী অনেক সংবাদমাধ্যমই বলছে চূড়ান্তভাবে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ৪ এপ্রিল উইকিলিকস তাদের এরূপ অনুমানের কথাই বলেছিল এবং তা ছিল সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক।

এ যুগের এক চে গুয়েভারা অ্যাসাঞ্জ
জানার অধিকারের জন্য লড়াইয়ে বিশ্বব্যাপী অ্যাসাঞ্জ ছিলেন এ যুগের চে গুয়েভারা। সে কারণেই বিশ্বমুরব্বি দেশগুলোর রোষানলে ছিলেন তিনি। বিশেষ করে আফগান ও ইরাকযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন কর্মকাণ্ডের শত শত দলিল বিশ্বব্যাপী ফাঁস করার মধ্য দিয়ে অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকস দেখিয়েছিল সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে ন্যাটো জোট আসলে কী করে বেড়াচ্ছে। মূলত এরূপ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রতিশোধ হিসেবেই অ্যাসাঞ্জকে স্বেচ্ছা–আশ্রয় থেকে জোর করে আজ তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। অ্যাসাঞ্জই আরও কয়েক সহযোগীসহ উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশ্ব গণমাধ্যমের ইতিহাসে বিশ্বের আর কোনো প্রতিষ্ঠান উইলিকসের মতো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘হুমকি’ হয়ে উঠতে পারেনি।

তাঁকে গ্রেপ্তারের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল গত নভেম্বর থেকে। যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় গোপনে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা তৈরির কথা ফাঁস হয়ে যায়। ওই সংবাদে দেখা গিয়েছিল, ‘অ্যাসাঞ্জ’ নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার প্রস্তুতি চলছে। এই সংবাদ ফাঁসের পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এর সঙ্গে উইলিকসের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কোনো সম্পর্ক নেই বলেছিল। তবে বৃহস্পতিবারের ঘটনা স্পষ্ট বলছে, এই দুই ঘটনার আন্তসম্পর্ক থাকার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালেও গত বছর ১৬ নভেম্বর বলা হয়েছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্র অ্যাসাঞ্জকে বিচার করার ব্যাপারে আশাবাদী।’ অ্যাসাঞ্জের আইনজীবী ব্যারী পোলাক সব সময়ই এসব সংবাদের প্রতিবাদে করে যাচ্ছিলেন এই বলে, ‘সত্য প্রকাশ কখনো ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে না।’

মধ্যস্থতা করছিলেন পল মেনাফোর্ট
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই অ্যাসাঞ্জকে হাতে পেতে মরিয়া হলেও তা সহজ ছিল না। এ ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে ইকুয়েডরের কীভাবে দর–কষাকষি চলেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত গত ৩ ডিসেম্বরের একটি প্রতিবেদন থেকে। সেখানে দেখা যায়, ২০১৭-এর মে থেকে রিপাবলিকান দলীয় রাজনীতিবিদ ও লবিস্ট পল মেনাফোর্ট ও ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে অন্তত তিন দফা বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকের মূল বিষয় ছিল অ্যাসাঞ্জকে হস্তান্তরের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ মওকুফ। এই আলাপ সফল হওয়ার পরই লন্ডনের ১১ এপ্রিলের ঘটনা ঘটল। চলতি প্রকাশ্য অধ্যায় হলো, আসলে পল মেনাফোর্টের গোপন অধ্যায়ের ফলাফলের প্রথম অংশ। পল মেনাফোর্ট একসময় ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রমের ব্যবস্থাপক ছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে রাশিয়ার সাহায্যের অধ্যায়েও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল বলে বিভিন্ন তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তার অধ্যায়েও এ মুহূর্তে তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে সর্বত্র।

সাত বছরের বন্দিত্ব থেকে আরেক বন্দিত্বে
২০১০ সালে সুইডেনে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এক যৌন হয়রানির বিতর্কিত মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে লন্ডনে অবস্থান করাকালে সেখানেও তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। মূলত এই শেষোক্ত গ্রেপ্তার এড়াতেই তিনি ২০১২-এর জুনে ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই বছরের আগস্টে ইকুয়েডর তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ারও ঘোষণা দেয়। অথচ বৃহস্পতিবার ইকুয়েডর দূতবাসের কর্মকর্তারা ব্রিটেনের পুলিশকে ডেকে অ্যাসাঞ্জকে তাদের হাতে তুলে দেয়। এ থেকে স্পষ্ট, ইকুয়েডরের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মতিতেই ঘটনাটি ঘটেছে।

ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী এবং রক্ষণশীল দলের এমপি অ্যাসাঞ্জের ‘গ্রেপ্তারের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য’ ইকুয়েডরকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং বিশেষভাবে দেশটির প্রেসিডেন্ট মরেনওর প্রশংসা করেছেন। এ থেকেও স্পষ্ট, পুরো প্রক্রিয়াটি সচেতন পরিকল্পনামাফিকই হয়েছে। যা উল্লেখিত পল মেনাফোর্টের কার্যক্রম–সম্পর্কিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোকে সমর্থন করে।

মূলত মরেনওকে সামনে রেখে এবং ব্রিটেনের রাজনীতির নাজুক সময়ের সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রই পর্দার আড়াল থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ইকুয়েডরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট দুর্নীতির দায়ে জনবিক্ষোভের মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এ মুহূর্তে বাড়তি সাহায্য প্রত্যাশী। এ রকমও তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যে অ্যাসাঞ্জকে হস্তান্তরের বিনিময়ে ইকুয়েডরকে দেওয়া ঋণগুলো মাফ করে দিতে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে রাজি হয়েছে। বিনিময়ে অ্যাসাঞ্জকে হাত পাওয়ার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প দেশটির প্রভাবশালী সমর প্রশাসনের কাছে নিজেকে কূটনীতিকভাবে দক্ষ এক অভিভাবক হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন। আর অ্যাসাঞ্জকে প্রবেশ করতে সাত বছরের স্বেচ্ছাবন্দিত্ব থেকে অনির্দিষ্ট আরেক দীর্ঘ বন্দিত্বে।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর এক বৈশ্বিক আঘাত
গত এক দশক ধরে উইকিলিকস ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ছিলেন বিশ্বব্যাপী মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জানার অধিকারের জন্য লড়াই করা সংগ্রামী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনের সারিতে। উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যরাজি থেকেই বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক কুকীর্তির কথা জানতে পারত দুনিয়ার মানুষ। সে কারণেই কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রনায়কেরা ও করপোরেট শক্তি অ্যাসাঞ্জকে স্তব্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। ইকুয়েডরের মার্কিন পুতুল প্রেসিডেন্ট মরেনও ক্ষমতায় আসামাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট সেই সুযোগ পেল। অ্যাসাঞ্জের আটক নিঃসন্দেহে বিশ্বব্যাপী স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর একটা আঘাত।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক